চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে দিনভর সচিবালয় ঘেরাও করে রাখার পর রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন আনসার সদস্যরা। গতকাল রোববার রাত সাড়ে নয়টার দিকে সচিবালয়ের সামনে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, প্রথম আলোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আসিফ হাওলাদারসহ অন্তত ৪০ শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় কয়েকজন আনসার সদস্য আহত হন। পরে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া খেয়ে রাত পৌনে ১০টার দিকে সচিবালয় এলাকা ত্যাগ করেন আনসার সদস্যরা। তাঁদের একটি অংশ জিপিও হয়ে, আরেকটি অংশ প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে চলে যায়।
সচিবালয়ে আনসার সদস্যরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহসহ অনেককে আটকে রেখেছেন, রাতে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। আনসার সদস্যদের প্রতিহত করতে তাঁরা মিছিল নিয়ে সচিবালয় এলাকায় যান। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। সারা দিন ভেতরে আটকে থাকার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপদেষ্টা, সচিব ও সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা সচিবালয় থেকে বের হতে সক্ষম হন। গেটের সামনে তাঁদের স্বাগত জানান শিক্ষার্থীরা। রাত পৌনে ১১টার দিকে পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ।
চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে কয়েক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনে থাকা আনসার সদস্যরা।
গতকাল সকালে প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হন তাঁরা। পরে ভাগ হয়ে সচিবালয়ের চারপাশে পাঁচটি গেটে অবস্থান নেন। সচিবালয়ের চারপাশের সড়ক বন্ধ করে সমাবেশ শুরু করেন তাঁরা। সচিবালয়ের পাঁচটি গেট বন্ধ করে দেওয়ায় ভেতরে কেউ ঢুকতে পারেননি, আবার কেউ বেরও হতে পারেননি। বেলা আড়াইটার দিকে আনসার সদস্যদের কাছে আসেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ। আনসার সদস্যদের দাবি যৌক্তিক উল্লেখ করে মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন দুই উপদেষ্টা।
বিকেল চারটায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসেন আনসার সদস্যদের সাত প্রতিনিধি। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, আনসারদের মধ্যে বিশ্রামের যে প্রথা চালু আছে, সেটা থাকবে না। তাঁরা নিয়মিত চাকরি করে যেতে পারবেন। বিকেলেই আনসারদের দাবি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সময় আনসার সদস্যদের কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
কিন্তু বিকেল পাঁচটার দিকে আনসার সদস্যরা কর্মকর্তাদের ভেতরে জিম্মি করে তাঁদের প্রধান দাবি চাকরি জাতীয়করণ করতে চাপ দেন। গতকাল রাতেই প্রজ্ঞাপন জারি করার কথা বলেন। সরকারের কাছ থেকে জাতীয়করণের ঘোষণা শুনে তাঁরা কর্মস্থলে ফিরতে চান বলে জানান।
এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ৫৫ হাজার আনসার সদস্যের চাকরি জাতীয়করণ করতে হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিতে হবে। কত টাকা বাড়তি প্রয়োজন হবে, তা বিশ্লেষণ করতে হবে। এসব বিশ্লেষণ না করে প্রজ্ঞাপন জারি করা যায় না। সরকারের এসব যুক্তি না মেনে সচিবালয়ের চারপাশ ঘেরাও করে রাখেন আনসার সদস্যরা। তাঁরা সচিবালয়ের ভেতর থেকে কাউকে বের হতে দেননি। ভেতরে অধিকাংশ কর্মকর্তা আটকা পড়েন। এভাবে চলতে থাকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত।
পরে সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাসে বলেন, আনসার সদস্যরা সচিবালয়ে তাঁদের আটকে রেখেছেন। তাঁরা শিক্ষার্থীদের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হতে বলেন। সাড়ে নয়টার দিকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে সচিবালয়ের দিকে আসতে থাকেন। তখনই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রথমে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ছিল কম। তখন আনসার সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। তখন অন্তত ৪০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। এ সময় শিক্ষার্থীরা পিছু হটে শিক্ষা চত্বরে অবস্থান নেন। পরে চারদিক থেকে হাজারো শিক্ষার্থী এসে আনসার সদস্যদের ধাওয়া দেন। এ সময় বের হতে দুটি পথ তাঁদের জন্য খোলা রাখা হয়। একটি অংশ জিপিও হয়ে, আরেকটি অংশ প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে চলে যান। এ সময় আনসারদের ওই এলাকা থেকে বের করে দিতে পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা এক পাশ খালি রাখেন। তবে অর্ধশতাধিক আনসার সদস্য সচিবালয়ের ২ নম্বর গেটের সামনে আটকা পড়েন। তখন সেনাবাহিনীর সদস্য ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাল হয়ে তাঁদের রক্ষার চেষ্টা করেন। আনসার সদস্যরা তাঁদের গায়ে থাকা ড্রেস শিক্ষার্থীদের দিকে ছুড়ে মারলে সেগুলোতে আগুন দেন শিক্ষার্থীরা। রাত পৌনে ১১টার দিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন পুরো এলাকা ছিল হাজারো শিক্ষার্থীর দখলে।
দিনভর বিক্ষোভে যানজট
সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস হওয়ায় ঢাকার সব রাস্তা ছিল ব্যস্ত। তবে আনসার সদস্যদের আন্দোলনের মুখে সচিবালয়ে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সচিবালয়ে অবস্থানকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সচিবালয়ের পাঁচটি গেট বন্ধ করে দেওয়ায় ভেতরে কেউ ঢুকতে পারেননি, আবার কেউ বেরও হতে পারেননি। সচিবালয় ঘেরাও করে আনসার সদস্যদের সমাবেশের কারণে প্রেসক্লাব, পল্টন, হাইকোর্ট, জিপিও, গুলিস্তান এলাকায় দেখা দেয় দীর্ঘ যানজট। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন অফিসগামী মানুষ। দীর্ঘক্ষণ তাঁরা যানজটে বসে থাকেন। অনেকেই হেঁটে কর্মস্থলে রওনা দেন। আবার অনেকে গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো পথে চলে যান। সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকতে না পেরে বিভিন্ন দপ্তর থেকে আসা কর্মকর্তারা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পরে সভায় অংশ না নিয়ে অনেক কর্মকর্তাকে চলে যেতে দেখা যায়। আনসারদের সমাবেশের কারণে পুরো এলাকা স্থবির হয়ে যায়।
চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে কয়েক দিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন আনসার সদস্যরা। তাঁদের বক্তব্য, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাঁরা চুক্তিতে কাজ করেন। মাসিক বেতন ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা। সরকারের কাছ থেকে ন্যূনতম সুবিধা পান না তাঁরা। তিন বছর পরপর ৩ থেকে ৯ মাস বিশ্রামে রাখা হয় আনসার সদস্যদের। ওই সময় তাঁদের বেতনসহ কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না। কোনো প্রতিষ্ঠান যখন মনে করে তাদের নিরাপত্তার জন্য জনবল প্রয়োজন, তখন তারা জনবল চেয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরে আবেদন করে। পরে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সদস্যদের থাকা-খাওয়া ও অস্ত্র রাখার জায়গা এবং দুই মাসের অগ্রিম বেতন দেওয়া সাপেক্ষে নির্ধারিত সংখ্যক সদস্যকে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের বেতন দেয় মূলত নিয়োগকারী সংস্থা। এটি চুক্তিভিত্তিক চাকরি। রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে চাকরি স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি বেতন–ভাতা, ঈদ বোনাস, পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন। সে জন্য তাঁদের এই আন্দোলন। রাকিবুল ইসলাম নামের এক আনসার সদস্য জানান, সারা দেশে তাঁদের আনসার সদস্য ৫৫ হাজার। যে টাকা বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চালানো যায় না।
দাবি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে কমিটি
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনে সাধারণ আনসার, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্লাটুন কমান্ডার (এপিসি) ও প্লাটুন কমান্ডারদের (পিসি) উত্থাপিত দাবি পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে সুপারিশ করতে গতকাল সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদকে। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে সরকারের কাছে সুপারিশসংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।