বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যু
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নেই জাতীয় পরিকল্পনা
২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কৌশলপত্র বা পরিকল্পনা নেই সরকারের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডেঙ্গুর চিকিৎসায় গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ স্বাস্থ্য বিভাগের না। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশ অতীত থেকে শিক্ষা নেয়নি বলে বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এ বছর ১০টি জেলা বাদ দিয়ে সব জেলায়ই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, দেশের সব শহরেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে। সারা দেশের সব শহর ও উপজেলা পর্যায়ে মশা নিয়ন্ত্রণের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। অনেক জেলায় মশা নিয়ন্ত্রণে জনবল নেই, নেই সরঞ্জাম ও কীটনাশক। মশা নিয়ন্ত্রণের আলোচনায় সিটি করপোরেশনগুলো কী করছে, সেই বিষয়টি বেশি আলোচনায় আসে।
ডেঙ্গুতে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার আরও চারজনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ১১০। এর চেয়ে বেশি মৃত্যু ছিল ২০১৯ সালে, ১৭৯ জন। এ বছর ২৮ হাজার ৬৯৮ জন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে। এর চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হয়েছিল ২০১৯ সালে, ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়নি, বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কোনো পরিকল্পনা দেওয়া হয়নি। এই মশা থাকলেই রোগী থাকবে। এখন যে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে, তা ছিল অবধারিত।’
চাপ বাড়ছে হাসপাতালে
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য তিনটি পৃথক ওয়ার্ড ডেঙ্গু রোগীর জন্য বরাদ্দ। হাসপাতালের ষষ্ঠ তলার ৬৩৪ নম্বর ওয়ার্ড পুরুষ ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। গতকাল ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি শয্যায় মশারি টানানো। রোগী সব মশারির মধ্যে। কিছু রোগী বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ওয়ার্ডের ৪৩ নম্বর শয্যায় স্থান হয়েছে কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী আবুল কালামের। কালাম জানাল, মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকায় একটি বহুতল ভবনের নিচতলায় তাদের বাসা। এলাকায় মশার উপদ্রব খুব বেশি। ১৫ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে সে।
হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল ১৯ জন রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু নতুন ভর্তি হয়েছে ২৯ জন। বেলা একটা পর্যন্ত রোগী ভর্তি ছিল ১২৯ জন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ওপর চাপ বেড়েছে। রোগী আরও বাড়লে নতুন ওয়ার্ড খোলার দরকার হতে পারে।’
রোগীর চাপ বাড়ছে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে। গতকাল এই হাসপাতালে ৭০টি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি ছিল। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে বলে হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। চতুর্থ তলার ২৪ শয্যাবিশিষ্ট ১৪ নম্বর ওয়ার্ডটি বুকের দুধ খায় এমন ছোট শিশুদের জন্য।
১২টি শয্যা ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য, বাকি ১২টি অন্যান্য সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য। বেলা ১১টায় ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কোনো শয্যা খালি নেই। হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ২৪টি শয্যায় ডেঙ্গু রোগী আছে। আইসিইউতে আছে ৬টি শিশু। বাকি ২৮টি শিশু বিভিন্ন ওয়ার্ডে রয়েছে। এ বছর এই হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ১০টি শিশু মারা গেছে।
গতকাল ওই হাসপাতালে ‘আবুল হোসেন রেসপিরেটরি সেন্টার ও নিউমোনিয়া রিসার্চ সেন্টার’ উদ্বোধনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গুতে প্রতিদিন ৫–৬ জনের মৃত্যু হচ্ছে। এক হাজারের মতো নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। মশা মারার স্প্রে করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্প্রে করে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন ঢাকা শহরের ৪১টি সরকারি–বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগীর তথ্য প্রকাশ করে। গতকালের দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, একমাত্র পঙ্গু হাসপাতাল ছাড়া অন্য সব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী আছে। সবচেয়ে বেশি রোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গতকাল সেখানে ২০১ জন রোগী ভর্তি ছিল। এই হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১২ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
মশা সারা দেশে, গ্রামেও
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি, তার মধ্যে আছে কক্সবাজার, যশোর ও পাবনা। যশোরে এ পর্যন্ত ৪৬০ জন আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। অন্যদিকে যশোর সিভিল সার্জন কার্যালয় গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ৩৫৪ জন রোগী অভয়নগর উপজেলার। এর বেশির ভাগ রোগী উপজেলার চল্লিশা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের।
অন্যদিকে পাবনা জেলায় ৫২৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ জন রোগী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের।
গতকাল পর্যন্ত ১০টি জেলার কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। জেলাগুলো হলো কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, রাঙামাটি, বান্দরবান, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
মশাবিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এডিশ মশা যে শুধু বড় বড় শহরে থাকে, এমন নয়। মশা এখন দেশের প্রায় সব জায়গাতেই আছে। ঝুঁকি এখন আর বড় শহরে সীমাবদ্ধ নেই। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ ঢাকার বাইরে সারা দেশে ছড়াতে হবে।’
দরকার জাতীয় পরিকল্পনা
২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক কে কৃষ্ণমূর্তি এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে মধ্যবর্তী পরিকল্পনা বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিলেন। পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রণালয়, রেল মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। কোন মন্ত্রণালয় কী ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করবে, তা–ও সংক্ষিপ্ত আকারে বলা হয়েছিল।
এ পরিকল্পনা নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার অনেক কাজের মধ্যে একটি মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া নিয়ে কাজ করা। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক ইকরামুল হক প্রথম আলোকে জানান, যক্ষ্মা, এইচআইভি/এইডসসহ বেশ কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কর্মকৌশল আছে। ডেঙ্গু নিয়ে এমন কোনো দলিল নেই।
রোগনির্ণয় শাখা এ বছর ঢাকায় দুবার মশা জরিপ করেছে, এক হাজারের মতো চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এ ছাড়া দুই হাজার চিকিৎসকের কাছে ডেঙ্গুর চিকিৎসা নির্দেশিকা পাঠিয়েছে তারা।
জাতীয় পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল প্রণয়ন এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে যুক্ত করে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ বে–নজির আহমেদ।
এর পাশাপাশি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে মশাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করা, মাঠপর্যায়ে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে কাজ করা, পরিস্থিতি নজরদারি করা।