কেন মরছে মা মাছ ও ডলফিন, গবেষকেরা যা বলছেন
চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদীতে সম্প্রতি আবারও বেড়েছে মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যুর ঘটনা। গত এক সপ্তাহে নদীর বিভিন্ন অংশে মৃত চারটি মা মাছ ও একটি ডলফিন ভেসে উঠেছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে হালদা গবেষকদের।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ অ্যান্ড ল্যাবরেটরির হিসাব অনুযায়ী, গত সাড়ে পাঁচ বছরে হালদা নদীতে অন্তত ৪৩টি ডলফিন এবং ২৫ থেকে ৩০টি বড় মা মাছের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ মৃত্যুই ছিল অস্বাভাবিক। মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যুর পেছনে গবেষণাগারটিতে যেসব কারণ শনাক্ত করা হয়, এর মধ্যে রয়েছে আঘাত, শ্বাসকষ্ট ও দূষণ।
হালদা নদীবিষয়ক গবেষকেরা জানান, স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির উদ্যোগের কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে হালদা নদীতে মা-মাছ ও ডলফিনের মৃত্যুর ঘটনা তেমন ঘটেনি। তবে সম্প্রতি হঠাৎ করে মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
গবেষকদের দাবি, প্রাথমিকভাবে তাঁদের মনে হয়েছে, এবার যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, এর জন্য দায়ী নদীর পানিদূষণ। পানির নমুনা পরীক্ষায়ও এর সত্যতা মিলেছে বলে জানান গবেষকেরা।
হালদা নদীবিষয়ক গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যুর খবরে তিনি গত শুক্রবার নদীর মদুনাঘাটের কাটাখালী অংশের পানির নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৩ দশমিক ৬ মিলিগ্রামে নেমে এসেছে। এর আদর্শ মান ৫ মিলিগ্রাম। পানিতে মুক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের মান স্বাভাবিকের (প্রতি লিটারে ৫-১০ মিলিগ্রাম) তুলনায় বেড়ে প্রতি লিটারে ২০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। আবার পিএইচের মান স্বাভাবিক সর্বনিম্ন সীমার (৬ দশমিক ৫) একদম কাছাকাছি (৬ দশমিক ৬)।
শফিকুল ইসলাম বলেন, কাটাখালী শাখাখালের মাধ্যমে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য হালদায় পড়ছে। এসব বিষাক্ত ট্যানারির বর্জ্যে ক্রোমিয়াম, লেড, আর্সেনিক এবং বিভিন্ন জৈব অ্যাসিড রয়েছে। এসব জৈব অ্যাসিড পানির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে পানিতে পিএইচের মান কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রামের নিচে হলে মাছের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রভাব দেখা দেয় এবং দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান প্রতি লিটারে ২ মিলিগ্রামের নিচে এলে মাছের মৃত্যু হতে পারে।
হালদা-গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেন, চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও বাহির সিগন্যাল, অক্সিজেন, কুলগাঁও-সংলগ্ন বেশ কিছু কলকারখানা থেকে ৬ থেকে ৮টি খাল দিয়ে বিষাক্ত ও তৈলাক্ত বর্জ্য নদীতে পড়ছে। এ ছাড়া হাটহাজারীর খন্দকিয়া, কৃষ্ণ, কাটাখালী ও বাথুয়া খাল দিয়ে নদীতে পড়ছে গৃহস্থালি বর্জ্য। এসব দূষণ থেকে নদীকে রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা হতাশজনক।
মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেন, সম্প্রতি মারা যাওয়া মা মাছের কয়েকটি দেখে ধারণা করা হচ্ছে, দূষণের কারণে শ্বাসকষ্টে এসব মাছের মৃত্যু হয়েছে। দূষণের মাত্রা এবারের প্রজনন মৌসুমে সর্বোচ্চ।
হালদা-গবেষকেরা জানান, নদীটিতে প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুন মাসে ৫ থেকে ৮ দফায় কার্পজাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে। এবার প্রজনন মৌসুমে ডিম পাওয়া গেছে খুবই কম। এতে ডিম সংগ্রহকারীরাও হতাশ।
হাটহাজারীর দক্ষিণ মাদার্শা ইউনিয়নের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হালদার সঙ্গে যুক্ত খালের দূষিত পানি ব্যবহার করায় প্রায় হাজার একর জমি নষ্ট হয়ে গেছে। এলাকার খাল-বিল, জলাশয়ও দূষিত পানির কারণে মাছশূন্য।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির জলজ প্রাণী রক্ষায় সরকার ২০০৭ সালে নদীর কর্ণফুলীর মোহনা থেকে ফটিকছড়ি, নাজিরহাট পর্যন্ত এলাকাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে নদীর সব স্থানে বালুর ইজারা মহাল তুলে নিয়ে বালু উত্তোলন এবং বালুবাহী ড্রেজার, যান্ত্রিক নৌ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। জাল পাতার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এসব উদ্যোগের কারণে মা মাছের মৃত্যু কমে এসেছিল।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম মশিউজ্জামান বলেন, সংবাদমাধ্যমে নদীদূষণের খবর পেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তিনি বিষয়টি অবহিত করেন। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজন পরিদর্শনে আসার কথা থাকলেও তাঁরা আসেননি। রোববার (আজ) তাঁরা নদীর বিভিন্ন শাখাখাল ও মোহনা পরিদর্শন করবেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার সহকারী পরিচালক ফেরদৌস আনোয়ার বলেন, হালদার দূষণ নিয়ে এক সপ্তাহ আগে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। চার সদস্যের কমিটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে কারখানাসহ দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে কাজ করছেন।
চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, হালদার দূষণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হবে। এরপর দূষণের কারণ নির্ধারণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।