সংস্কার কমিশনে প্রস্তাব
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা চায় পুলিশ
পুলিশের এই প্রস্তাবসহ আরও কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি উঠেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে।
নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা বাড়াতে জেলা ও মহানগর (মেট্রোপলিটন) এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা চায় পুলিশ। তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঠেকাতে জননিরাপত্তা কমিশন গঠনের দাবিও করেছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন সূত্র ও তাদের খসড়া প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করে ৯০ দিনের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা। সে হিসেবে আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই প্রতিবেদন জমা পড়ার কথা।
খসড়া প্রতিবেদনটি তৈরির আগে পুলিশের কাছে আমরা মতামত চেয়েছি। তারা মতামত দিয়েছে। এটি এখন খসড়ামাত্র। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব প্রস্তাব না-ও থাকতে পারে।আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ, পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশে সংস্কারের সুপারিশ পেতে ৩ অক্টোবর পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ৯ সদস্যের কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে পুলিশ সংস্কারের নানা দিক সম্পর্কে বলা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খসড়া প্রতিবেদনটি তৈরির আগে পুলিশের কাছে আমরা মতামত চেয়েছি। তারা মতামত দিয়েছে। এটি এখন খসড়ামাত্র। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব প্রস্তাব না-ও থাকতে পারে।’
ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা চায় পুলিশ
কমিশন সূত্র জানায়, খসড়া প্রতিবেদনে পুলিশের বেশ কিছু প্রস্তাব যুক্ত করা হয়। এর একটি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা। খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ আইন ১৮৬১–এর ধারা ৫ অনুসারে পুলিশ মহাপরিদর্শকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে এই ক্ষমতা নিরঙ্কুশ ও অবারিত নয়, সরকারনিয়ন্ত্রিত। পুলিশে অপারেশন (কার্যক্রম পরিচালনা) সক্ষমতা বাড়াতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকা প্রয়োজন, অর্থাৎ আইজিপির ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে এবং তা তিনি অধস্তন কর্মকর্তাদের কাছে অর্পণ করবেন।
আইনানুগ, প্রায়োগিক অথবা অন্য কোনো জটিলতার আশঙ্কা থাকলে বিকল্প হিসেবে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রেষণে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ করা যেতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া প্রতিবেদনে।
খসড়া প্রতিবেদন নিয়ে গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সংস্কার কমিশনের বেশ কয়েকটি প্রস্তাবে আপত্তি তোলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যার একটি হলো ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা। বৈঠক সূত্র জানায়, সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ। পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা গেছে। তাদের যদি বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে পুলিশ আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে প্রস্তাবিত জননিরাপত্তা কমিশনের প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত একজন আইজিপিকে রাখার সুযোগ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
জননিরাপত্তা কমিশন
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঠেকাতে জাতীয় জননিরাপত্তা কমিশন চায় পুলিশ। খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করা হয়। এ হস্তক্ষেপ ঠেকানো, পুলিশের জবাবদিহি বাড়ানো, পুলিশ বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা বাড়ানো, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য জাতীয় জননিরাপত্তা কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। এই কমিশনের কাজ হবে, পুলিশের দৈনন্দিন কার্যক্রম মূল্যায়ন করা। পুলিশে কর্মরত সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অনুসন্ধান করে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা।
জননিরাপত্তা কমিশন ১৩ সদস্যবিশিষ্ট করার প্রস্তাব এসেছে খসড়া প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়, কমিশনের চেয়ারপারসন হবেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা একজন অবসরপ্রাপ্ত আইজিপি। সদস্যদের মধ্যে চারজন হবেন সংসদ সদস্য। দুজন সরকারি দলের। একজন প্রধান বিরোধী দলের। একজন অন্য দলের। অন্য মনোনীত ব্যক্তিরা হবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, একজন অবসরপ্রাপ্ত সাবেক আইজিপি, সমাজবিজ্ঞানের দুজন শিক্ষাবিদ, একজন মানবাধিকারকর্মী ও গণমাধ্যমকর্মী। থাকবেন স্বরাষ্ট্রসচিব ও পুলিশের আইজিপি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে প্রস্তাবিত জননিরাপত্তা কমিশনের প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত একজন আইজিপিকে রাখার সুযোগ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের মাধ্যমে দেশে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে। এরপর যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, প্রতিটি পৃথক আইনে চলছে। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করবেন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে পেশাদার শিক্ষক ও গবেষক দিয়ে। দেশে অপরাধের ধরন বদলেছে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। অপরাধের বিবর্তন মোকাবিলার পাশাপাশি নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে আলাদা একটি পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি হয়ে পড়েছে।
এর আগে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২২ সালে পুলিশ সপ্তাহে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করা হয়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সব ধরনের সহযোগিতার কথা বলা হয়। তবে বিষয়টি আর এগোয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন গঠন করা হয়েছে পুলিশকে জনবান্ধব করার জন্য। এখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সময় নয়।
খসড়া প্রতিবেদনে পুলিশ সংস্কারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন সুপারিশ রাখা হয়েছে। কমিশনের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশকে পেশাদার ও জবাবদিহির আওতায় আনতে যা করণীয় প্রতিবেদনে তা-ই থাকবে।