গবেষণাহীন প্রবন্ধের বই প্রকাশ, গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের কম মূল্যায়ন ও চর্চা কম হওয়ায় দেশে গঠনমূলক জ্ঞানচর্চায় অনেক বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। গত পনেরো বছরে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘জেনোসাইড’ (গণহত্যা) ঘটেছে। রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার নিয়ে শত শত মানহীন বই বেরিয়েছে। যেসব বই গুরুত্বপূর্ণ বইকে আরও বেশি পিছিয়ে রেখেছে। অষ্টম নন-ফিকশন বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা ও অনুষদের যৌথ আয়োজনে অষ্টমবারের মতো আয়োজিত হলো এই বইমেলা। সোমবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত এ মেলার সমাপনী হয় এবারের পুরস্কার বিজয়ীদের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ইতিহাস, গবেষণা, আত্মজীবনী—এমন নানা বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে গত ২৮ ডিসেম্বর ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী এ মেলা শুরু হয়।
এ বছর চারটি বইয়ের জন্য এর লেখক ও প্রকাশককে পুরস্কৃত করা হয়েছে। গত বছর পর্যন্ত দুটি করে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ২০২৪–এর নন ফিকশন মেলার আয়োজনে পুরস্কার পেলেন কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত ‘সাতচল্লিশের দেশভাগ গান্ধী ও জিন্নাহ’ বইয়ের জন্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘বিংশ শতাব্দীর সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ: ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি’ বইয়ের জন্য হায়দার আকবর খান রনো (মরণোত্তর), প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘অর্থশাস্ত্র: ইতিহাস দর্শন রাষ্ট্রনীতি’ বইয়ের জন্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এবং অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতি: মওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব’ বইয়ের জন্য লেখক ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দীন সাথী।
সমাপনী অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, নন–ফিকশন বইয়ের বাজার সীমিত নয়। গত পাঁচ বছরে প্রথমা থেকে প্রকাশিত ৫০টি ফিকশন সাহিত্যের চেয়ে দুটি নন-ফিকশন বই অনেক বেশি বিক্রি হয়েছে। এ সময় তিনি ইউপিএল থেকে প্রকাশিত তাঁর নন–ফিকশন বই ‘শেয়ারিং গাঙ্গেজ ওয়াটার ইন্দো-বাংলাদেশ ট্রিটিস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ল–এর প্রসঙ্গও তুলে ধরেন।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা ক্রমাগত ফেসবুক থেকে তথ্য নেওয়া জাতিতে পরিণত হয়েছি। জ্ঞানের রাজ্যে আমাদের জেনোসাইড হয়েছে গত ১৫ বছরে।’ তিনি বলেন, এ কে খন্দকারের একটি বক্তব্যের জের ধরে প্রথমা তাঁর বই পুনর্মুদ্রণের সাহস পায়নি কয়েক বছর ধরে। সেখানে এই অভ্যুত্থানের পর জ্ঞানচর্চার উন্মুক্ত সুযোগ তৈরি হয়েছে। সামনে এমন মেলা আরও হোক।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, সব দেশেই জনপ্রিয় বই বেশি বিক্রি হয়। সে তুলনায় যেসব বই মানুষকে ভাবতে শেখায়, তা নিয়ে চর্চা হয় কম। এমন ব্যবস্থা থেকে দেশের পাঠকের মনের উত্তরণ ঘটাতে প্রতিবছর বণিকবার্তা যে আয়োজন করে আসছে, তার জন্য সাধুবাদ জানাই। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন।
পুরস্কার পাওয়া লেখকদের বক্তব্যে প্রথমে বক্তব্য দেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ননফিকশন বই নিয়ে আলোচনা হয় না। রিভিউ তো হয়ই না। এখানে গণমাধ্যম, গণগ্রন্থাগার, গ্রন্থকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। দেশকে অগ্রসর করতে হলে নন–ফিকশন বই নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বই মানুষের চিন্তার অনুশীলনের সহযোগী। নন–ফিকশন ক্রমাগত মূল্যবান হয়ে উঠছে, তা দেখা যাচ্ছে। নিজের বইটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশভাগকে আমরা স্বাধীনতা বলি, তবে এর ফলে যে বিপর্যয় হয়েছে, তা আমরা জানি না বা সেসব ভাবতে চেষ্টা করি না। সেসব কথাই এ বইটিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।’
সিরাজউদ্দীন সাথী বলেন, মাওলানা ভাসানীর আন্দোলন দেশকে একটি মোক্ষম সুযোগ এনে দিয়েছিল। সে সুযোগও হাতছাড়া হয়েছে। এরপর তাকে ইতিহাসের বিস্মরণের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে লেখাটা প্রয়োজন ছিল।
অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্যে বণিকবার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে অনেক হতাশার মধ্যে দিয়েও ভালো কাজ হয়। দেশকে জ্ঞানভিত্তিকভাবে এগিয়ে নিতেই ২০১৫ সাল থেকে বণিক বার্তার এই উদ্যোগের শুরু।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য সায়মা হক ও মামুন আহমেদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মাহমুদ ওসমান ইমাম, জুরি বোর্ডের সদস্য ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, ফারুক মঈনউদ্দীন এবং আল আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের এমডি কাজী মাহমুদ করিম।