ঝুঁকিপূর্ণ মোড়ে ৩৮ পদচারী-সেতুর একটিও হয়নি

পদচারী–সেতু না থাকায় ব্যস্ত সড়কে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার করতে হয় লোকজনকে। গত সোমবার দুপুর ১২টায় চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট এলাকায়ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ততম মোড়ের অন্যতম ২ নম্বর গেট। চৌরাস্তার মোড় দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হন। নিরাপদ পারাপারের জন্য মোড়টিতে দুটি পদচারী-সেতু (ফুটওভার ব্রিজ) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর করেছিলেন তৎকালীন মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। এক বছর পার হলেও এখনো পর্যন্ত কাজই শুরু হয়নি। এতে সড়ক পারাপারে পথচারীদের ঝুঁকি রয়ে গেছে।

২ নম্বর গেটসহ নগরের ৩১টি ব্যস্ততম মোড় ও এলাকায় ৩৮টি পদচারী-সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের পৌনে তিন বছর পার হলেও ২৭টির কাজই শুরু হয়নি। ১১টির কাজ শুরু হলেও কোনোটিরই কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে চারটির কাজ।

সড়কে অব্যবস্থাপনার কারণে পথচারীদের রাস্তা পারাপার ও চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম নগর। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম নগরের সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নগরে তিন বছরে (২০২০-২৩) সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬৩ জন। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ ছিলেন পথচারী। ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রপিস ইনিশিয়েটিভ ফর গ্লোবাল রোড সেফটির (বিআইজিআরএস) সহযোগিতায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম নগর পুলিশ ও ভাইটাল স্ট্র্যাটেজিস নগরের নিরাপদ সড়ক নিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

পৌনে তিন বছরেও কাজ শেষ হয়নি

‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি পদচারী-সেতু নির্মাণ করার কথা ছিল। ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৪৯০ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে পদচারী-সেতু নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় ৫৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর। তবে গত ৫ জুন মেয়াদ আরও দুই বছরের জন্য বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত পর্যন্ত সড়কে ১১টি পদচারী-সেতু নির্মাণ করা হবে বলে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) উল্লেখ করা হয়েছিল। দুটি করে পদচারী-সেতু নির্মাণ হবে টাইগারপাস, জিইসি, ষোলোশহর ২ নম্বর গেট, অক্সিজেন, বহদ্দারহাট, অলংকার ও সিটি গেট মোড়ে।

এ ছাড়া লালখানবাজার, দেওয়ানহাট, চৌমুহনী, বাদামতলী, বারিক বিল্ডিং, নিমতলা, সল্টগোলা ক্রসিং, সিমেন্ট ক্রসিং, কেইপিজেড, কাঠগড়, মুরাদপুর, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, টেকনিক্যাল, একে খান, সাগরিকা, নয়াবাজার, রুবি গেট, কুলগাঁও স্কুলের সামনে, মনসুরাবাদ, এক্সেস রোডের মুখে, মহিলা কলেজের মোড়ে, সরাইপাড়া স্কুলের মোড়, আকবরশাহ ও সানোয়ারা স্কুলের মোড়ে পদচারী-সেতু নির্মাণ করার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, ১১টা সেতু নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। জিইসি ও ২ নম্বর গেট মোড়ের কাজ বন্ধ। ৭টি মোড়ের বিষয়ে দরপত্র মূল্যায়ন করছে কর্তৃপক্ষ। তিনটি সেতুর নকশা প্রস্তুত করা হয়েছে। আর নিমতলা, টাইগারপাস ও লালখান বাজার মোড়ে পদচারী-সেতু নির্মাণ করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

পৌনে তিন বছর পার হলেও কেন সেতু নির্মাণ করা যায়নি, এ প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মাটি পরীক্ষা ও সেতুর নকশা করতে সময় লাগছে। এ ছাড়া নির্মাণকাজ করতে গিয়ে অনেক সেবাপ্রদানকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে হচ্ছে। দেখা গেছে, সেতুর জন্য নির্ধারিত স্থানের নিচে বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন চলে গেছে। পরে কথা বলে এসব বিষয়ে সমাধান করতে হয়েছে।

ঝুঁকি নিয়ে পারাপার

গত সোমবার সকাল ৯টা। নগরের জিইসি মোড়ে পার হয়ে জাকির হোসেন সড়কের দিকে যাচ্ছিলেন পথচারী নুর আহমদ খন্দকার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেয়ে সালমা খন্দকার। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে যানবাহনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি রাস্তা পার হয়েছেন। পরে প্রথম আলোকে নুর আহমদ বলেন, এই ব্যস্ত মোড়ে পদচারী-সেতু খুব দরকার। এটি না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হতে হচ্ছে। অনেক সময় যানবাহন গায়ের ওপর উঠে যায়। মোড়ে কোনো শৃঙ্খলা নেই।

সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রুবি গেট, ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট মোড় ঘুরে বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। এসব মোড়ে যানবাহন চলছিল এলোমেলোভাবে। যাত্রী ওঠানামাও করছিলেন যে যার মতো। আর পথচারীরা এসব যানবাহনের ফাঁক গলে পার হচ্ছিলেন। তাঁদের কারও কোলে ছিল শিশু। কেউ ব্যাগপত্র নিয়ে, আবার কেউ দৌড়ে এসব মোড়ের একপাশ থেকে অন্য পাশে গেছেন।

বায়েজিদ এলাকার রুবি গেটে রাস্তা পার হওয়ার সময় কথা হয় জোছনা বেগমের সঙ্গে। তিনি স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। থাকেন হিলভিউ এলাকায়। জোছনা বেগম বলেন, এই সড়কে বেশ কিছু শিল্পকারখানা রয়েছে। এসব কারখানার ভারী ট্রাক নিয়মিত বায়েজিদ সড়ক দিয়ে চলাচল করে। ফলে রুবি গেট এলাকায় দ্রুত পদচারী-সেতু নির্মাণ করা গেলে পথচারীদের ঝুঁকি কমে যেত।

পদচারী-সেতু না থাকায় যানচলাচলেও অসুবিধা হচ্ছে বলে জানান একাধিক যানবাহনের চালক ও চালকের সহকারী। এসব মোড়ে ১০ জন চালকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, সেতু থাকলে মোড়ের ওপর চাপ অনেক কমে যেত। যানজট কম। পথচারীরা সেতু ব্যবহার করে সহজেই পারাপার হতে পারতেন। কিন্তু এখন দেখা যায়, পথচারীদের জন্য গতি কমে যাচ্ছে।  

নগরের পতেঙ্গা থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত চলাচল করা ১০ নম্বর বাসের চালক মোক্তার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এই সড়কে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ১৫টি মোড়ে পদচারী-সেতু দরকার। সেতু নির্মিত হলে মোড়ের যানজট অনেকটা কমে যাবে। একবারের যাত্রায় অন্তত ৩০ মিনিট সময় বেঁচে যাবে। প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পারি দিতে এখন দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগছে।

দ্রুত সময়ের মধ্যে পদচারী-সেতু নির্মাণকাজ শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ করতে না পারা, দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদারদের গাফিলতি; এসব সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ফলে কার গাফিলতি কিংবা কী কারণে এখনো পদচারী-সেতু নির্মাণ করা গেল না তা খতিয়ে দেখতে হবে।