ঢাকার গুলিস্তানের হইহল্লার মধ্যে বিবর্ণ এক ভবনে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র অবস্থিত। গত কয়েক বছরে সেখানে যতগুলো অনুষ্ঠানে গিয়েছি, সবার মুখেই অনুযোগ, যানজট ঠেলে সরকারি এই দপ্তরে পৌঁছানো বিরাট ঝক্কির। সরকারি আমলাদের মুখেই কথাটি বেশি শুনেছি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানটি সারা দেশের বেসরকারি গণগ্রন্থাগারের দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত।
তারপরও ভবনটির শ্রীবৃদ্ধি কিংবা স্থানান্তর এমনকি এর সামনে থেকে যানজট নিয়ন্ত্রণের কোনো পদক্ষেপ নেই। সেখানে যে এমন একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ ভবন’ আছে মনেই হয় না। বইপত্র, লেখাপড়া বা গ্রন্থাগারের প্রতি আমাদের সামগ্রিক উদাসীনতার এ যেন এক প্রতীকী উপস্থাপন। মানে একটা থাকলেই আর কি! সৈয়দ মুজতবা আলীর বই কেনা গল্পের সেই ‘ড্রয়িংরুম বিহারিণী’র মতো, যিনি গেছেন স্বামীর জন্মদিনে বাজারে উপহার কিনতে। ‘দোকানদার এটা দেখায়, সেটা শুঁকায়, এটা নাড়ে, সেটা কাড়ে, কিন্তু গরবিনী ধনীর (উভয়ার্থে) কিছুই আর মনঃপূত হয় না। সবকিছুই তাঁর স্বামীর ভান্ডারে রয়েছে। শেষটায় দোকানদার নিরাশ হয়ে বললেন, ‘তবে একখানা ভালো বই দিলে হয় না?’ গরবিনী নাসিকা কুঞ্চিত করে বললেন, ‘সেও তো ওঁর একখানা রয়েছে।’
আজ ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। এই তো সেদিন, ২০১৮ সাল থেকে দেশে দিবসটি উদ্যাপিত হচ্ছে। এর আগে এ নামে কোনো দিবসই ছিল না, কেউ ভাবেনি।
সরকারিভাবে একটি ক্রোড়পত্র, একটু আলোচনা, আর বেসরকারি উদ্যোগে হয়তো কোনো শোভাযাত্রা—এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দী হয়ে পড়েছে দিবসের সামগ্রিক কার্যক্রম।
কিন্তু গ্রন্থাগার চর্চা, সারা দেশে বই পড়ার আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া এক দিনের কোনো বিষয় নয়। লাইব্রেরি সক্রিয় করা ও পাঠাভ্যাস বৃদ্ধিতে করণীয় নিয়ে সারা বছরই কথা বলতে হবে। আশার কথা হলো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু আলোচনা, কিছু কথা ও কাজ হচ্ছে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গ্রন্থাগারগুলো কিছুটা সক্রিয় হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর পেছনে আছে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কিছু সংগঠকের মধ্যে এমন ধারণা এসেছে, সরকারের কাজ সরকার করবে, কিন্তু সরকারের ওপর তাদের নির্ভরশীল হলে চলবে না। তাদের কাজ করতে হবে নিজস্ব চিন্তা থেকে। দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে।
তারপরও সরকারের ভূমিকা সামনে চলে আসে। করোনাকালে বলা হয়েছিল, ক্ষতিগ্রস্ত বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর জন্য এককালীন অনুদান দেওয়া হবে, বার্ষিক বরাদ্দ বাড়ানো হবে। আদতে তার কিছুই হয়নি, বরং কমেছে।
বেসরকারি লাইব্রেরির জন্য সরকারি অনুদান বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে অনুদান দেওয়া হচ্ছে, তা খুবই অপ্রতুল। ২০ বা ৩০ হাজার টাকা দিয়ে একটা লাইব্রেরির দুই মাসের খরচও হয় না। এসব কারণে এখন কিছু প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগার আর অনুদানের জন্য আবেদনই করে না।
আবার এটাও বলতে হবে, সরকারি অনুদানের সঠিক ব্যবহারও হচ্ছে না। যে বারো শতাধিক বেসরকারি গ্রন্থাগার সরকারি অনুদান পাচ্ছে, তারা সে অনুদান কাজে লাগাচ্ছে কি না, তা নজরদারির ব্যবস্থা দুর্বল। দিনের পর দিন কেবল সাইনবোর্ড-সর্বস্ব পাঠাগার অনুদান পেতে পারে না।
২.
এক দশক ধরে গ্রন্থাগারের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছি। যোগ দিয়েছি বেশ কিছু সেমিনারে। কথা বলেছি, মতবিনিময় করেছি। ‘ঢাকার গণপাঠাগার: আলোয় ভরা ভুবন’ নামে আমার একটি গবেষণাগ্রন্থও বেরিয়েছে, ২০২০ সালে। সব মিলে দেশের গণগ্রন্থাগারগুলো কেমন চলছে, সে বিষয়ে এই অবসরে একটি আলোকপাত করতে চাই।
পাঠকেরা গ্রন্থাগারে আসেন বইয়ের আকর্ষণে। কিন্তু ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিপুলসংখ্যক গ্রন্থাগার সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখেছি বৈচিত্র্যপূর্ণ বইয়ের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি গ্রন্থাগারে। গতানুগতিক ধারার কিছু বই নিয়ে গ্রন্থাগার পরিচালিত হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে যে বই দেওয়া হয়, অনেক সময় সেসব বই তাকে সাজিয়ে রাখা হয় না। বাক্সবন্দী পড়ে থাকে। এ বিষয়ে একটা সরেজমিন গবেষণা হতে পারে। সাহিত্য, ইতিহাস ও জ্ঞানবিজ্ঞানের বই বেশি দিতে হবে। প্রয়োজনে গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষকে বই বাছাই করার সুযোগ দিতে হবে।
২০১৬ সালে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি গ্রন্থাগার নিয়ে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন করেছিলাম। বৈচিত্র্যপূর্ণ বইয়ের অভাবের কথা জেনে লেখক ও বিজ্ঞানী ড. রেজাউর রহমান তাঁর লেখা সব বইয়ের একটি করে কপি সেখানে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কামরাঙ্গীরচর গিয়ে একটি ছোট্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর লেখা ৩৭টি বই সেখানে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।
বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলো অনেক সময় উচ্ছেদ হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। কারণ, স্থায়ী জায়গা নেই বেশির ভাগের। ঢাকায় একাধিক লাইব্রেরির কথা জানি, কেবল বারবার জায়গা পরিবর্তনের কারণে পাঠক হারিয়েছে। ঢাকার বাড়িওয়ালারা কেবল বছর বছর বাসাভাড়া বাড়ান না, কোনো গ্রন্থাগার উচ্ছেদ করতে চাইলে সহজ তরিকা হলো, ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া। ঢাকার বাইরেও গ্রন্থাগারের জন্য জায়গা বরাদ্দ পাওয়া সহজ কাজ নয়। এ বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা নীতিমালা করার উদ্যোগ নিতে পারে।
গ্রন্থাগার খালি পড়ে থাকে, পাঠক যায় না। এটা একটা জনপ্রিয় কথা। এর সহজ সমাধান নেই। দুটো কথা বলি। বর্তমানে বেশির ভাগ গ্রন্থাগারের নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখতে পাব, তখন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হতো নিজস্ব বক্তব্য প্রচারের জন্য। সেই মত বা অনুসারীরা সেসব গ্রন্থাগারের সভ্য হতেন। এখন সাধারণ গ্রন্থাগারগুলোর গঠনতন্ত্রে নিজস্ব কোনো শক্ত কথা থাকে না। কিন্তু থাকা দরকার। সমাজে বৈষম্য, মানবাধিকার, সুশাসন, নারীর অধিকার, বিতর্ক চর্চা—নানা কিছু নিয়েই কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
পাশাপাশি গ্রন্থাগারগুলো যদি তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের লেখক, কবি, অধ্যাপকসহ বিশিষ্টজনদের যুক্ত করতে পারে, তাহলে সেই গ্রন্থাগারটি সক্রিয় হতে পারে। একবার নাটোর শহরের একজন সংগঠককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁর শহরে একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক বাস করেন। তাঁর নাম জানেন কি না। ওই সংগঠক তা বলতে পারেননি।
এমনিতে নিয়মিত কার্যক্রম চালানোর জন্য জনবলের বিরাট ঘাটতি রয়েছে। তারপরও গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য যে দু-একজনকে পাওয়া যায়, সেই উদ্যোক্তা বা স্বেচ্ছাসেবী দিন শেষে একা মানুষ। এটা অবশ্য ব্যক্তির সাংগঠনিক দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। আবার কখনো লেখাপড়ার কারণে তাঁকে এলাকা ছাড়ার প্রয়োজন হয়। তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারটি টেকে না।
স্বেচ্ছাসেবীর ভাতার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। লাইব্রেরি পরিচালনার সঙ্গে যেসব স্বেচ্ছাসেবী জড়িত, তাঁদের ভাতা ও ক্ষমতায়ন করা দরকার। স্থানীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাজে তাঁদের যুক্ত করা দরকার।
আজকাল গ্রন্থাগার পরিচালনার সঙ্গে এমন কিছু লোক যুক্ত হচ্ছেন, পাঠাগার-বইপত্রের প্রতি তাঁদের বিশেষ আবেগ নেই। এমনকি তাঁদের ন্যূনতম পড়াশোনাও নেই। সমাজে দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তাঁদের উদ্দেশ্য। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা মূলত এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি করতে চান। এমনকি রাজনৈতিক দলে পদও পেতে চান।
আরেকটি চিত্র দেখা যায়। তা হলো, যে লাইব্রেরিটি কিছুটা ভালো করার চেষ্টা করছে, সেখানে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসে ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করছেন।
বিদ্বজ্জনেরা বলেন, কেবল বই পড়লে হবে না, প্রাপ্ত জ্ঞান নিজের ও অপরের অর্থাৎ সমাজের কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য দরকার পাঠচক্র। আজকাল অনেক লাইব্রেরি পাঠচক্রের ধরনে পরিবর্তন এনেছে। যে বইয়ের ওপর পাঠচক্র, সেই কেন্দ্রিক পরিবেশে গিয়ে সভ্যরা আলোচনা করছেন। এতে বিষয়টি বুঝতে সহজ হচ্ছে, মনে গেঁথেও যাচ্ছে। যশোরের একটি গ্রন্থাগার বেশ নাম করেছে এ ক্ষেত্রে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ বিষয়ে কাজ করতে পারে।
পাঠাগারগুলো যে এই সমাজের অংশ এবং পাঠাগারকেন্দ্রিক নতুন নতুন উদ্যোগের যে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার, তা নীতিনির্ধারকদের মাথায় থাকে না। এমনকি সমাজের বিত্তবানেরাও তা ভাবেন না। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর খাতে যে অর্থ ব্যয় করে, গ্রন্থাগারগুলো তা থেকে কিছু পায় না। যাঁরা গ্রন্থাগারে দান করবেন, করের ক্ষেত্রে তাঁদের ছাড় দেওয়া যেতে পারে, এমন আলোচনা অনেক দিন ধরে হচ্ছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সবখানেই উদাসীনতা।
লেখক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মফিদুল হক প্রায়ই একটা কথা বলেন। আমরা জনগণের অর্থে চাকচিক্যময় অবকাঠামো তৈরি অবশ্যই করব। কিন্তু এর প্রয়োজনীয়তা, একে টিকিয়ে রাখা, এর গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য দরকার দেশপ্রেমিক মানবিক মানুষ।
আর এমন মানুষ তৈরির ঠিকানা হলো জনগণের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত গণগ্রন্থাগারগুলো। তাই এ দেশের মানুষের মেধা-মনন তৈরিতে, রুচি ও সংস্কৃতি বিকাশে গ্রন্থাগারের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই সার্বিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে। কিন্তু সেটা কবে। আর কত দেরি পাঞ্জেরি?
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]