উৎকোচ দাবির মামলায় স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) তৎকালীন এক সহকারী উপপরিদর্শককে (এএসআই) বিচারিক আদালতের দেওয়া দুই বছরের কারাদণ্ডাদেশ বহাল রেখে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। ওই এএসআই পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের (পরিচয়-ঠিকানা যাচাই) জন্য উচ্চ আদালতের এক বিচারপতির বাসায় গিয়ে তাঁর স্ত্রীর কাছে উৎকোচ দাবি করেছিলেন।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এএসআই মো. সাদেকুল ইসলামের আপিল নামঞ্জুর করে হাইকোর্টের একটি একক বেঞ্চ গত বছরের ২২ আগস্ট রায় দেন। ২৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গত মাসে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
অভিমতে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘নাগরিকদের পাসপোর্টসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হয়। এই পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন পেতে নাগরিকদের যথেষ্ট আর্থিক ও মানসিক ভোগান্তি হরহামেশাই পোহাতে হচ্ছে। এই মামলাটি তার একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত।’
মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, ওই মামলায় ২০১৯ সালের ২১ মার্চ রায় দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯–এর বিচারক। রায়ে সাদেকুল ইসলামকে (সাময়িক বরখাস্ত) দণ্ডবিধির ৪১৯ ধারায় এক বছর এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় আরও এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। উভয় ধারায় দেওয়া দণ্ড পৃথকভাবে চলবে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গি থানার চড়োল গ্রামে সাদেকুল ইসলামের বাড়ি। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন সাদেকুল ইসলাম।
আদালতে সাদেকুলের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. তয়েদ উদ্দিন খান। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে আইনজীবী এ এস এম কামাল আমরোহী চৌধুরী এবং রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক চৌধুরী শুনানিতে ছিলেন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, সাদেকুল ইসলাম ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের দুই মেয়ের পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাঁর ধানমন্ডির বাসায় উপস্থিত হয়ে নিজেকে পুলিশের এসআই সালাম হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বিচারপতির স্ত্রী ডা. সাবরিনার কাছে ভেরিফিকেশনের জন্য জনপ্রতি এক হাজার টাকা হিসেবে দুই হাজার টাকা দাবি করেন। ডা. সাবরিনা বিষয়টি বুঝতে না পেরে আসামি সাদেকুলকে চা-নাশতা করার জন্য বকশিশ দিতে চাইলেও তিনি তা নিতে অস্বীকার করে বলেন যে দুই হাজার টাকা না দিলে পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে না। ডা. সাবরিনা বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে অবস্থানরত তাঁর স্বামীকে অবহিত করলে তিনি সাদেকুলকে বাসা ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। আসামি এএসআই সাদেকুল তাঁর পরিচয় গোপন করে বিচারপতির বাসায় এসআই সালাম হিসেবে ভেরিফিকেশনের জন্য উপস্থিত হন। প্রকৃতপক্ষে ওই ভেরিফিকেশনের কাজটি তাঁর ছিল না; বরং এসআই সালামের ছিল।
নথিপত্র থেকে জানা যায়, ওই ঘটনায় উচ্চ আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত আদেশের নির্দেশনা অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগের তৎকালীন স্পেশাল অফিসার বেগম হোসনে আরা আকতার শাহবাগ থানায় সাদেকুলের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট মামলাটি করেন। তদন্ত করে দুদকের উপপরিচালক রাহিলা খাতুন আসামি সাদেকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। বিচারিক আদালত ২০১৯ সালে রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বিচারিক আদালতের রায় পর্যালোচনায় কোনো ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়নি। বিচারিক আদালতের রায় ও দণ্ডাদেশ সঠিক এবং ন্যায়ানুগ হয়েছে। আপিলটি নামঞ্জুর করা হলো। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আসামি–আপিলকারী (সাদেকুল) বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। ব্যর্থতায় বিচারিক আদালত আসামিকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
সাদেকুলের আইনজীবী মো. তয়েদ উদ্দিন খান শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি এখনো পাইনি। প্রত্যায়িত অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন সাদেকুল। এরপর হা্ইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।’