ইয়েমেনে অবরুদ্ধ ৫৪৫ দিন
‘ভয়ংকরতম সশস্ত্র একদল সন্ত্রাসীর হাতে অপহৃত হতে যাচ্ছি’
ইয়েমেনের সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে দেশটির আবিয়ান ও সাবওয়াহ্ প্রদেশে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা ছিল। সেখানে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য গিয়েছিলেন এডেনে জাতিসংঘের সাব–অফিসে নিরাপত্তা সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে এম সুফিউল আনাম। কিন্তু তিনি ও তাঁর দলকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে। ৫৪৫ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে মুক্তি পান তিনি। সেই জিম্মিদশার রোমহর্ষক বর্ণনা তিনি দিয়েছেন প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি লেখায়। তাঁর সেই লেখাটি পাঠকদের জন্য তিন পর্বে প্রকাশ করা হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হল প্রথম পর্ব। আগামীকাল প্রকাশিত হবে দ্বিতীয় পর্ব: ‘চোখ বাঁধা অবস্থায় নেওয়া হলো পাথরের গুহার ভেতর’
‘স্যার, দেখো, উধার কুছ হো রাহা হ্যায়।’ আমার ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইয়েমেনি গাড়িচালক খালেদের কথায় মুখ তুলে সামনের দিকে তাকালাম। আমি সে সময় আইপ্যাডে ম্যাপের সঙ্গে আমাদের বর্তমান অবস্থান এবং রাস্তাটা মিলিয়ে নিচ্ছি। আইপ্যাড থেকে মুখ তুলে দেখতে পেলাম, রাস্তার ওপর একটা সাময়িক চেকপোস্টের সামনে আমাদের গাড়িবহরের প্রথমের এসকর্ট পিকআপটি দাঁড়িয়ে আছে। তার পেছনেই আমার দলের অন্য তিনজনকে বহনকারী গাড়িটিও দাঁড়ানো। আমাকে বহনকারী গাড়িটি ছিল তৃতীয় অবস্থানে। তার পেছনেই দ্বিতীয় সশস্ত্র এসকর্ট গাড়ি। সাধারণত এসব রাস্তায় স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সাময়িক চেকপোস্ট বানিয়ে রাস্তায় চলাচলরত যানবাহনে নিরাপত্তা তল্লাশি চালায়, যথাযথ পরিচয় পেলে ছেড়ে দেয়। যেকোনো দেশে জাতিসংঘের সদস্য ও যানবহরের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই স্বাধীনভাবে চলাচলের অধিকার আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী সদস্যদেশগুলো সে আইন মানতে বাধ্য। তাই আমি এই সাময়িক বাধায় চিন্তিত হলাম না।
আমাদের চলার পথে এই ধরনের পরিস্থিতিতে গাড়ি থেকে নামা বারণ। তাই আমি ভাবছি, কী করব?
তবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগছিল বলে আমার কিছুটা সন্দেহ হতে লাগল। এমন সময় দেখি, সামনের গাড়ি থেকে আমার দলের সবাই নেমে যাচ্ছে। আর অস্ত্রধারী একজন লোক তাদের গাড়ির পাশে লাইন করে দাঁড় করাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আরেকজন সশস্ত্র লোক আমার গাড়ির সামনে এসে আমাকে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত করল। আমাদের চলার পথে এই ধরনের পরিস্থিতিতে গাড়ি থেকে নামা বারণ। তাই আমি ভাবছি, কী করব?
আমাকে ইতস্তত করতে দেখে সশস্ত্র লোকটি তার জ্যাকেটের ভেতর থেকে একটা গ্রেনেড বের করে দেখাল। ইশারায় সেটা ফাটিয়ে দেওয়ার হুমকি দিল। উপায়ান্তর না দেখে সবাইকে নিয়ে আমি গাড়ি থেকে নামলাম। সশস্ত্র লোকটি আমাকে অস্ত্রের মুখে দাঁড় করিয়ে আরবি ভাষায় চিৎকার করে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করল। আমি ইংরেজি আর ভাঙা ভাঙা আরবিতে কিছু বলার চেষ্টা করতেই লোকটা আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাকে শার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে তাদের একটি গাড়িতে তুলল আর আশপাশ থেকে একে-৪৭ অস্ত্র হাতে বেরিয়ে এল স্কার্ফে মুখ ঢাকা আরও কিছু লোক। তারা আমাকে গাড়িতে ওঠাতে দেখে জান্তব উল্লাসে রক্ত হিম করা কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘আল্লাহু আকবর!’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, এটা একটা অপহরণের ঘটনা। আমরা সম্ভবত পৃথিবীর ভয়ংকরতম সশস্ত্র একদল সন্ত্রাসীর হাতে অপহৃত হতে যাচ্ছি।এভাবেই শুরু হলো আমাদের অপহরণের নাটক, সিনেমা বা গল্পের চেয়েও যা রোমহর্ষ ও শ্বাসরুদ্ধকর।
এভাবেই চলতে থাকলাম। সময় দীর্ঘ হলেও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক গাড়ি আর ভালো রাস্তার কারণে ক্লান্তি আসেনি। সাড়ে এগারোটা নাগাদ আল-ওয়াদিয়াহ্ পৌঁছে গেলাম।
সেনাবাহিনী থেকে জাতিসংঘ
২০০৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে আমি জাতিসংঘে যোগ দিই। ২০২২ সালে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান শহর এডেনে জাতিসংঘের সাব-অফিসে নিরাপত্তা বিভাগে, অর্থাৎ ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট ফর সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটিতে (ইউএনডিএসএস) নিরাপত্তা সমন্বয়কারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। সেখানে কর্মরত জাতিসংঘের সব এজেন্সির কর্মী বাহিনী আর স্থাপনার নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। সেই সুবাদে তাদের বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করার আগে আমি তাদের সব ধরনের নিরাপত্তাবিষয়ক আদেশ, নির্দেশ ও উপদেশ দিয়ে থাকি। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সংঘাতপূর্ণ এলাকার নিরাপত্তা মূল্যায়ন আর ছাড়পত্র দেওয়াও আমার দায়িত্বের অংশ।
ইয়েমেনের সাম্প্রতিক সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে দেশটির আবিয়ান ও সাবওয়াহ্ প্রদেশে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকায় তার মোকাবিলা করার জন্য সেখানে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করার আশু প্রয়োজন দেখা দেয়। এই কার্যক্রমে সহায়তা দিতে আমি সেসব এলাকায় দুই দিনের একটি নিরাপত্তা মূল্যায়ন অভিযানের পরিকল্পনা করি।
অভিযান শুরুর তারিখ ঠিক হয় ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। আমরা এডেন থেকে যাত্রা করে প্রথমে যাব আবিয়ান প্রদেশের আল-ওয়াদিয়াহ্ জেলায়। সেখানে কাজ শেষ করে যাব একই প্রদেশের আল-মাহফাদ জেলায়। সেখান থেকে যাব আটাক জেলায়। সেখানে রাত যাপন করে পরদিন সকালে যাব আরও উত্তরে যুদ্ধবিধ্বস্ত জেলা আইন শহরে। আটাক ও আইন জেলা দুটিই সাবওয়াহ্ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। সেখানকার কাজ শেষ করে আবার ফিরব আটাকে। ১১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মিশন শেষ হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে ওই দিন বিকেল নাগাদ এডেনে পৌঁছে যাব।
এই ছিল আমার রোড অ্যাসেসমেন্ট এবং নিরাপত্তা মূল্যায়ন অভিযানের পরিকল্পনা।
নিরাপত্তা মূল্যায়ন অভিযান
আমরা ৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার সকাল ছয়টায় এডেন থেকে রওনা দিলাম। স্থানীয় নিরাপত্তা সংস্থার দেওয়া দুই গাড়ি সশস্ত্র এসকর্ট ছাড়াও আমাদের বহরে রয়েছে জাতিসংঘের দুটি সাঁজোয়া যান। দুজন ড্রাইভারসহ আমরা মোট ছয়জন যাত্রী। আমি ছাড়া বাকি সবাই ইয়েমেনের অধিবাসী।
আবহাওয়া বেশ উষ্ণ। সুন্দর রাস্তা। রাস্তার ডান পাশে বালুকাময় বেলাভূমি আর চমৎকার সমুদ্র। রাস্তায় বিরতির কোনো পরিকল্পনা নেই। আমরা একবারে আল-ওয়াদিয়াহ্ পর্যন্ত যাব। পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লাগবে। চলার পথে মাঝেমধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে দাঁড়াতে হয়। আমাদের সঙ্গের স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এসকর্ট সদস্যরা আমাদের পরিচয় দিলে চেকপোস্টে কর্তব্যরত লোকেরা গাড়ি ছেড়ে দেয়। মাঝেমধ্যে গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে।
এভাবেই চলতে থাকলাম। সময় দীর্ঘ হলেও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক গাড়ি আর ভালো রাস্তার কারণে ক্লান্তি আসেনি। সাড়ে এগারোটা নাগাদ আল-ওয়াদিয়াহ্ পৌঁছে গেলাম। স্থানীয় নিরাপত্তাপ্রধান ও প্রশাসনিক-প্রধানদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক আগেই ঠিক করা ছিল। আমরা পৌঁছানোমাত্র তাঁরা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে অফিসে নিয়ে গেলেন। প্রধান কর্মকর্তা ছাড়া সেখানে আরও ছিলেন গোত্রপ্রধান শেখরা এবং তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা। প্রায় সবাই সশস্ত্র। যুদ্ধরত একটি দেশ। ছেলে থেকে বুড়ো সবাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ইয়েমেনের বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে বহু বছর ধরে। নানা দেশের হস্তক্ষেপে গত সাত থেকে আট বছরে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়েছে।
স্থানীয় কর্মকর্তারা বেশ আগ্রহ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিলেন। তাঁরা সব সময়ই জাতিসংঘের দলকে সাদরে গ্রহণ করেন। জাতিসংঘের সাহায্য-সহযোগিতার আশায় পথ চেয়ে থাকেন। আলোচনার শুরুতে আমি আমাদের মিশনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলাম। বেশ সফল আলোচনাই হলো। তাঁরা আমাদের দুপুরে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আমরা সবিনয়ে অপারগতা জানিয়ে তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
আমাদের যেতে হবে পরের জেলা আল-মাহফাদ, উদ্দেশ্য একই। সেখান থেকে আটাক জেলায়। ওখানে গিয়ে রাত যাপন করব।
এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা খাবার কেনার পাশাপাশি কাত কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাত বা খাত একধরনের উদ্ভিদ। এর পাতা নেশাদ্রব্য হিসেবে সেবন করা হয়।
অফিসে আলোচনা শেষ করে আমি বাইরে এসে নিরাপত্তাপ্রধানের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বললাম। এরই মধ্যে আমাদের সঙ্গে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা খাবার কেনার পাশাপাশি কাত কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাত বা খাত একধরনের উদ্ভিদ। এর পাতা নেশাদ্রব্য হিসেবে সেবন করা হয়। ইয়েমেন, পূর্ব আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বেশ জনপ্রিয় একটি নেশাদ্রব্য। তারা কাতের কচি পাতা পান খাওয়ার মতো করে দিনভর চিবোয়। চিবানো পাতা গালের মধ্যে জমিয়ে ধীরে ধীরে রস আস্বাদন করে। এর প্রচণ্ড প্রভাবে স্নায়ু উত্তেজিত হয়। ছাত্রদের অনেকে পরীক্ষার আগে কাত খেয়ে রাত জেগে পড়াশোনা করে। রাতের গাড়িচালকেরা কাত চিবিয়ে গাড়ি চালাতে পছন্দ করে। এতে তাদের স্নায়ু সজাগ থাকে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের পর এর প্রভাব চলে গেলে সেবনকারী নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আমাদের এসকর্ট সদস্যরা চলার পথে সজাগ থাকার জন্য সারা রাস্তা ধরে এই কাত চিবাতে থাকবে।
আল-ওয়াদিয়াহ্র প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সেরে রওনা হলাম আল-মাহফাদের উদ্দেশে। এই দুটি জেলাই সাবওয়াহ্ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা ইয়েমেনের এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। ইয়েমেনের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় তারা এই অঞ্চলে অবাধে বিচরণ করে। ইয়েমেনিদের জাতশত্রু শিয়া সম্প্রদায়ের হুতি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ওরা ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদে রত। হুতিদের বিরুদ্ধে ইয়েমেনের সুন্নি সম্প্রদায়ের অন্যান্য জনগোষ্ঠী ও সরকারি বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। এ কারণে ইয়েমেনের সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী আল-কায়েদার সদস্যদের কার্যকলাপে বাধা দেয় না। আল-কায়েদার সদস্যরা এর সুযোগ নিয়ে ইসলাম ধর্ম ও জিহাদের নামে অবাধে নানা ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। অবশ্য ১২ থেকে ১৫ বছর ধরে এসব এলাকায় বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
সবাই সশস্ত্র। দু-একজনের পরনে সামরিক পোশাক। সবার হাতে একে-৪৭ রাইফেল। প্রায় সবারই কোমরে বাঁধা ইয়েমেনি ড্যাগার ও জাম্বিয়া ড্যাগার। সেগুলোর হাতলের কারুকাজ বলে দেয় ব্যক্তিটির সামাজিক পদমর্যাদা কী।
বছর কয়েক ধরে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি প্রকট হয়ে ওঠায় এসব অঞ্চলে জরুরি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। একই কারণে ২০২২ সালে প্রায় চার লাখ শিশুর মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বাভাসের আলোকে জাতিসংঘ সেখানে জরুরি ভিত্তিতে মানবিক ও চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর তাগিদ দিচ্ছিল।
যাহোক, আরও দু-তিন ঘণ্টা চলার পর আমরা আল-মাহফাদে পৌঁছালাম। সেখানেও সরকারি প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ করলাম। তাঁরা আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা এবং সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। এখানে সরকারি প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা ছাড়াও গোত্র-সম্প্রদায়ের শেখ আর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা নিজ নিজ নিরাপত্তারক্ষীসহ উপস্থিত ছিলেন। আমার সঙ্গে থাকা স্থানীয় নিরাপত্তা সহকারীরা আমার আর তাঁদের মাঝখানে দোভাষীর ভূমিকা পালন করেন।
নিরাপত্তা মূল্যায়নের কাজ শেষ করে দিন শেষের গন্তব্য আটাকের উদ্দেশে রওনা দিলাম। সেখানে হোটেলকক্ষ বুক করা আছে। রাতযাপনের পর শুরু হবে পরবর্তী রোড অ্যাসেসমেন্টের কাজ। গন্তব্য আইন জেলা। সেখানে কয়েক সপ্তাহ আগেই ইয়েমেনের সুন্নি ও শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়েছে। পুরো এলাকায় বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠীর নিরাপত্তা বাহিনী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সংগত কারণেই জাতিসংঘের সব কার্যক্রম সে এলাকায় সাময়িকভাবে রহিত করা হয়েছে।
আমরা হোটেলে পৌঁছে যে যার রুমে গিয়ে রাতে হালকা কিছু খাবার আনিয়ে খেয়ে নিলাম। এর মধ্যে আমি আমার স্থানীয় নিরাপত্তা সহকারী মাজেনকে আটাকে অবস্থানকারী সাবওয়াহ্ প্রদেশের নিরাপত্তাপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সঙ্গে একটা বৈঠকের ব্যবস্থা করতে বললাম। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে স্থানীয় একটা হোটেলে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হলো। আমি খুব দ্রুত তাঁর সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু ঠিক করে নিলাম।
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা রওনা দিলাম আলোচনার উদ্দেশ্যে। আমার প্রধান উদ্দেশ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত আইন জেলার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা, সাবওয়াহ্ প্রদেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিশদ তথ্য সংগ্রহ করা, সরকারি সংস্থার দেওয়া সহযোগিতা বিষয়ে জানা ইত্যাদি। কারণ, জাতিসংঘের যেকোনো ধরনের মানবিক সহায়তা অভিযান পরিচালনা করতে হলে স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা সংস্থার সহযোগিতা অপরিহার্য।
হোটেলে পৌঁছে দেখি নিরাপত্তাপ্রধান তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে মহাসমারোহে কাত সেবন করছেন। আমরা ঘরে ঢুকতেই সাদরে বসার ঘরে অভ্যর্থনা জানিয়ে কাত সেবনের আহ্বান জানানো হলো। আমরা সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করে আলোচনা শুরু করলাম। যথারীতি সবিনয় সম্ভাষণ জানিয়ে নিরাপত্তাপ্রধানকে আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলাম। আমরা তাঁর পক্ষ থেকে কী কী সহযোগিতা পেতে চাই, তা-ও বিশদভাবে বললাম। সেই সঙ্গে ওই সব এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম।
নিরাপত্তাপ্রধান কাত চিবাতে চিবাতে মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। এরপর এই বলে নিশ্চিন্ত করলেন যে প্রদেশের সার্বিক অবস্থা এখন শান্ত। ইয়েমেনি নিরাপত্তা বাহিনী জাতিসংঘের যেকোনো কার্যক্রমে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেবে। আমরা আইন জেলায় যেতে চাই শুনে তিনি আশ্বস্ত করে বললেন, সপ্তাহখানেক আগে সেখানে যুদ্ধাবস্থা ছিল, তবে পরিস্থিতি এখন শান্ত। এলাকাটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তাঁর বাহিনীর হাতে রয়েছে। সেখানে আমাদের মিশন নিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা মিশনের নিরাপত্তাব্যবস্থার কয়েকটি বিষয় আলোচনা ও সমন্বয় করে বিদায় নিলাম।
মাইন বিছানো পথ ধরে
পরদিন সকালে ছুটলাম আটাক থেকে আইনের পথে। রাস্তার ডান পাশের দিগন্তে পাহাড়ের সারি। সামনে খোলা প্রান্তর। অ্যাসফল্টের প্রশস্ত সড়কটি অযত্ন ও অবহেলায় নষ্ট হয়েছে। স্থানে স্থানে এবড়োখেবড়ো, ভাঙা ও গর্ত। জনবসতি নেই বললেই চলে। মাইলের পর মাইল যাওয়ার পর হয়তো চোখে পড়বে একটা নিরাপত্তাচৌকি। সেখানে এক বা দুজন অস্ত্রধারী বসে বা দাঁড়িয়ে আছে। দায়সারা গোছের জিজ্ঞাসাবাদ করেই চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সুন্দর আবহাওয়া। চোখ আইপ্যাডে খোলা ম্যাপের ওপর। রাস্তা মিলিয়ে নিচ্ছি। মনে মনে কর্মপন্থা ঠিক করছি। পেছনে বসা নব্য অন্তর্ভুক্ত স্থানীয় নিরাপত্তা সহকারী বা লোকাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্টকে (এলএসএ) প্রয়োজনীয় নির্দেশ আর নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
ঘণ্টা দুয়েক চলার পর দেখলাম, ডান পাশের পাহাড় ক্রমেই কাছে আসছে। বুঝলাম, লোকালয় ঘনিয়ে এসেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া যুদ্ধের চিহ্ন আর ধ্বংসাবশেষ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। কিছু দূর যেতেই দেখা গেল রাস্তার দুপাশে ইতস্তত ছড়ানো অ্যান্টিপার্সোনেল ও অ্যান্টিট্যাংক মাইন। রাস্তার দুপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে মাইন বিছানো। যুদ্ধের সময় হুতিরা তাদের প্রতিপক্ষ ইয়েমেনি নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য মাইনগুলো বসিয়েছে।
শহরে ঢুকে দেখি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও জনমানবশূন্য এক বিরান জনপদ। অপরিকল্পিত ও অগোছালোভাবে গড়ে উঠেছে শহরটি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অল্প কিছু ঘরবাড়ি। তবে বসতি স্থাপন করা হয়েছে খুবই নিবিড়ভাবে। প্রতিটি ঘরে যুদ্ধের ধ্বংসের আলামত। কোনো কোনো বাড়ি পুরোপুরিই বিধ্বস্ত।
আমাদের গাড়িগুলো ধীরে ধীরে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে এগোচ্ছে দেখে স্থানীয় কিছু লোকজন এগিয়ে আসতে লাগল। সবাই সশস্ত্র। দু-একজনের পরনে সামরিক পোশাক। সবার হাতে একে-৪৭ রাইফেল। প্রায় সবারই কোমরে বাঁধা ইয়েমেনি ড্যাগার ও জাম্বিয়া ড্যাগার। সেগুলোর হাতলের কারুকাজ বলে দেয় ব্যক্তিটির সামাজিক পদমর্যাদা কী।
স্থানীয় লোকজন আমাদের সাদরেই গ্রহণ করল। জাতিসংঘ পরিচালিত সব মিশনকেই স্থানীয় মানুষ সহযোগিতার প্রতীক বলে মনে করে, তাদের কাছ থেকে মানবিক সহায়তা প্রত্যাশা করে। সে রকমই কোনো প্রত্যাশায় আমাদের তারা বরণ করে নিল। প্রথমে তারা আমাদের স্থানীয় একটা স্কুলঘরে নিয়ে বসাল। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা প্রতিনিধিরা একে একে যুদ্ধের পরিস্থিতি, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ভয়াবহতার বর্ণনা দিলেন। মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি তুলে ধরলেন বিশদভাবে। জাতিসংঘের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার আশাও ব্যক্ত করলেন। চারপাশে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ দেখে এবং তাঁদের বর্ণনা শুনে আমাদের কোনো সংশয়ই ছিল না যে আইনে খুব দ্রুত সব ধরনের মানবিক সহায়তা পাঠানো বিশেষভাবে জরুরি।
আমার মিশনের উদ্দেশ্য অবশ্য ভিন্ন; জাতিসংঘ পরিচালিত মানবিক সহায়তাকারী দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ ধরনের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় নিরস্ত্র একদল বেসামরিক মানবিক সহায়তাকারী কতটা নিরাপদে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে, সেটাই আমার মিশনের বিবেচ্য বিষয়। বিশেষ করে স্থানীয় সরকারি নিরাপত্তা সংস্থার সাহায্যে পরিচালিত মানবিক কার্যক্রম কতটা কার্যকর হবে, সেটা নির্ধারণ করা আমার প্রধান কাজ। কাজটি করা খুবই দুরূহ হবে বলে আমার মনে হলো। যুদ্ধের কারণে সরকারি প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এখানে প্রায় বিলুপ্ত বা অকার্যকর। তাদের পক্ষে বিপুল পরিমাণে সাহায্যসামগ্রী নিয়ে আসা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মাইনও জাতিসংঘের সদস্য ও যানবাহনের জন্য প্রচণ্ড হুমকির বিষয়।
আইনে যুদ্ধের সাময়িক বিরতি ঘটলেও এখনো প্রায়ই শহরের কাছাকাছি জায়গা থেকে গোলাগুলি ও কামানের আওয়াজ পাওয়া যায়। আবার সেখানে চরম মানবিক বিপর্যয়ও ঘটেছে। জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্য পাঠানো প্রয়োজন। কিন্তু মানবিক সাহায্য যাঁরা পরিচালনা করবেন, তাঁদের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। নইলে এখানে মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নয়। স্থানীয় লোকজন অসম্ভব আকুল কণ্ঠে জাতিসংঘের মানবিক সাহায্যের আবেদন জানালেন। তাঁদের অঞ্চলের প্রকৃত অবস্থা এবং মানবিক সহায়তার প্রয়োজনের কথা আমাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করব বলে তাঁদের আশ্বাস দিলাম। এর চেয়ে বেশি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কারণ, এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া আমার এখতিয়ারের বাইরে।
আমরা চারপাশ ঘুরে দেখতে বের হলাম। স্থানীয় লোকজন আমাদের আবার এখানে আসার জন্য বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন। আমি বুঝতে পারলাম, সাহায্যের জন্য তাঁরা কী রকম মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যুদ্ধের কারণে মানুষ, বিশেষ করে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের দুর্দশা বর্ণনার অতীত। এর শেষ কবে, কেউ জানে না। তাদের কাছে এর কোনো সমাধানও নেই।
আমরা আইনের পর্যবেক্ষণ শেষ করে ফিরে চললাম আটাকে। আবারও দুই পাশে মাইন বিছানো বিপজ্জনক রাস্তা। প্রচণ্ড গরমে উত্তপ্ত সড়ক ধরে দ্রুতগতিতে ছুটছে আমাদের সাঁজোয়া যান এবং স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দেওয়া সশস্ত্র এসকর্ট গাড়ি। পথে গাড়ির চাকা নিয়ে কিছুটা সমস্যা দিল। তা সারিয়ে নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই আটাকে ফিরে এলাম। অভিযান সফলভাবে শেষ হলো।