স্মৃতির বাক্স বায়োস্কোপ

নিজের কণ্ঠে ছন্দ তুলে ৪৫ বছর ধরে বায়োস্কোপ দেখান জলিল মণ্ডল। ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে জয়নুল উৎসবেছবি: প্রথম আলো

‘সুন্দরবনের বাঘ-ভালুক সামনে আছে, ডানে-বামে নজর করো, আরে নবাবেরই বাড়ি আছে, হাজার দুয়ারি ঘর আছে, দেখতে যত বাহার আছে, এক শ তলা বাড়ি আছে, এইবারেতে দেখেন ভালো, আরও কিছু রইয়া গেল...।’

জলিল মণ্ডলের অনেক কিছু রয়ে গেল সময়ের খাতায়। একসময়ের ভ্রাম্যমাণ বিনোদনের বাক্স বায়োস্কোপের দিন শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আকাশ সংস্কৃতি আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের কাছে পরাজিত হয়েছে বায়োস্কোপ। এই বায়োস্কোপ শুধু কাঠের বাক্সের ঘষা কাচে চোখ লাগিয়ে দুই মিনিট ছবি দেখা নয়। সঙ্গে রয়েছে ছন্দের বিস্ময়। সেটা তৈরি করতে হয় বায়োস্কোপওয়ালাকে নিজের কণ্ঠ, হাতের বাদ্যযন্ত্র, পায়ের ঘুঙুর ব্যবহার করে।

এখনো যাঁরা বায়োস্কোপ দেখান, তাঁদের অধিকাংশ এই কাজ করেন অডিও রেকর্ডের মাধ্যমে। শব্দযন্ত্রের সঙ্গে বাজানো হয় সেই রেকর্ড। কিন্তু ৪৫ বছর ধরে বায়োস্কোপ দেখিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো জলিল মণ্ডল এখনো কাজটি নিজে করেন। তাঁর কোনো রেকর্ডার নেই।

বায়োস্কোপে প্রতিটি শোর মেয়াদ সোয়া দুই মিনিটের মতো। তাতে ১০ থেকে ১২টি ছবি দেখা যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ১০০টি দল বায়োস্কোপ দেখলেও প্রতিবারই নিজের কণ্ঠে গান জলিল মণ্ডল। প্রতিবারই তাঁকে বাদ্যযন্ত্র প্রেমজুড়ি বাজাতে হয় বাঁ হাতের তাল ঠিক রেখে। ডান হাতে ঘোরে বায়োস্কোপের রিলের চাবি।

সদ্য শেষ হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে জয়নুল উৎসব-২০২৪-এ জলিল মণ্ডলকে দেখা গেল কণ্ঠের সঙ্গে মাটিতে সমানভাবে তাল রাখছেন পায়ের। তবে জরির সুতা, পুঁতি, হীরার মতো নকল কাচ দিয়ে নকশা করা লাল রঙের পোশাকটা একেবারে মলিন। একটিমাত্র পোশাক দিয়ে কয়েক বছর ধরে চালিয়ে নিচ্ছেন। জলিল মণ্ডল বললেন, ‘কাঠের এই বাক্সটার ভেতর সারা বছর জামা, টুপি আটকানো থাকে। ইঁদুরে কেটেছে। নতুন করে বানানোর পয়সা নেই।’ জানান, এখন আর কেউ বায়োস্কোপ দেখে না। বিভিন্ন জায়গার মেলা বা উৎসবে ডাক পেলে বাক্স নিয়ে ছুটে যান।

এই বাক্স নিয়েও ঝামেলা আছে। বাসে দুজনের সমান ভাড়া দিতে হয় বাক্সের জন্য। মাঝেমধ্যে বোঝা মনে হলেও বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারেন না। জলিল মণ্ডল বললেন, ‘আমি ১০ পয়সায়ও মানুষকে বায়োস্কোপ দেখাইছি। এখন ২০ টাকায় দেখাই। তা-ও মাঝেমধ্যে কেউ কেউ টাকা না দিয়ে চলে যায়।’

রাজধানীর উত্তরখানের বাসিন্দা পিয়ার আলীও বায়োস্কোপের বাক্স নিয়ে বের হন। তবে তিনি নিজের পেশার পরিসর বাড়িয়েছেন। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তি করে বায়োস্কোপ দেখান। ঢাকার মধ্যে হলে এক বেলার ভাড়া তিন হাজার টাকা, ঢাকার বাইরে চার হাজার টাকা। টেলিফোনে জানালেন, মাসে বেশি হলে চার থেকে পাঁচটি ডাক পান।

অধিকাংশ সময় বিয়ে, পিকনিক বা মেলায় যান পিয়ার আলী। এই সঙ্গে রয়েছে তাঁর নাগরদোলাসহ আরও কিছু কিছু লোক-উৎসবের আয়োজনের ব্যবস্থা। পিয়ার আলী জানান, তাঁর বায়োস্কোপের বাক্সের ভেতর আছে ছোট্ট একটি শব্দব্যবস্থা। মুখে বলে আবার এই অডিও ছেড়ে—দুইভাবেই তিনি বায়োস্কোপ দেখান।

১৮৯৮ সালে মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন বাণিজ্যিকভাবে প্রথম বায়োস্কোপ দেখাতে শুরু করেছিলেন। দীর্ঘদিন এটাই ছিল মানুষের কাছে অনন্য বিনোদন। জলিল মণ্ডলের বাবা, চাচারাও একসময় বায়োস্কোপ দেখাতেন।

জলিল মণ্ডল এখন আর বায়োস্কোপ দেখিয়ে সংসার চালাতে পারেন না। তিনি বেশির ভাগ সময় কৃষিকাজ করেন। উৎসবের ডাক পেলে বাক্স কাঁধে নিয়ে ছোটেন। তাঁর বায়োস্কোপে একসঙ্গে ছয়জন দর্শক দেখতে পারে। জয়নুল উৎসবে তাঁর এই বাক্সের ঘষা কাচে চোখ লাগিয়ে দেখা গেল সুন্দরবনের ডোরাকাটা বাঘ, শহীদ মিনার থেকে শুরু করে স্মৃতিসৌধ হয়ে তাজমহল, বড় লাটের বাড়ি আরও কত কিছু! কাঠের বাক্স থেকে চোখ সরিয়ে জানতে চাইলাম, আর কী কী দেখান আপনি? বায়োস্কোপওয়ালা করুণ হাসি দিয়ে বললেন ‘একসময় মানুষ এই বাক্সে দুনিয়া দেখত। এখন কত কিছু আছে, টিভি, মোবাইল। মানুষ কিছু দেখে না আর।’

সেদিন জয়নুল উৎসবে ভিড় কমতে থাকায় জলিল মণ্ডলকে অনুরোধ করলাম বায়োস্কোপের বাক্সটা খুলে দেখাতে। তিনি এক টানে ডালা খুলে দেখালেন, ভেতরটা শূন্য। মেলা শেষে নিজের ওই জীর্ণ ঝলমলে পোশাকটি ওতে রেখে আবার বাক্স কাঁধে নিয়ে ছুটবেন জলিল মণ্ডল।