হাতবদল হয়ে পরিবহনে এখন বিএনপির দুই সাইফুলের চাঁদাবাজি

  • ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনালেই দিনে চাঁদা ওঠে সাড়ে ১০ লাখ টাকা।

  • সওজের কালোতালিকাভুক্ত ৪৭ ঠিকাদারকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টার অভিযোগ।

  • এর আগে তেজগাঁও, মহাখালী টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর লোকেরা।

মহাখালী আন্তজেলা বাস টার্মিনালফাইল ছবি

বিএনপির দুই সাইফুলের চাঁদাবাজি চলছে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে। এই টার্মিনাল থেকেই দিনে সাড়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এই সাইফুলদের একজন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব। আরেকজন হলেন কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল আলম।

রাজনৈতিক ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি দখলে নেন কুমিল্লা বিএনপির সাইফুল। তিনি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেশের পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর ঢাকা উত্তর বিএনপির সাবেক নেতা সাইফুল আলম নিরব মহাখালী বাস টার্মিনালের বাইরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, কারওয়ান বাজার ও শেরেবাংলা নগর এলাকায় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

তেজগাঁও, শেরেবাংলা নগর, মহাখালী টার্মিনালসহ আশপাশের এলাকা দীর্ঘদিন ধরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের লোকজন নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫ আগস্টের পর আসাদুজ্জামান খান আত্মগোপনে চলে যান। তাঁকে ভারতে দেখা গেছে—এমন খবর বের হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসাদুজ্জামান খান কামাল যেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করতেন, এর সবই সাইফুল আলম নিরবের অধীন চলে এসেছে। কোথাও কোথাও বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। মহাখালী ও তেজগাঁও টার্মিনালে আসাদুজ্জামান খানের লোকজনকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি করছেন তিনি।

ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল ও তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল থেকে শুরু করে পরিবহন সমিতি এখন বিএনপিপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে।

অবশ্য চাঁদাবাজিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ২৯ সেপ্টেম্বর বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন সাইফুল আলম নিরব। এর আগে তিনি যুবদলের সভাপতি ছিলেন। তাঁর লোকজনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও এলাকায় থাকা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের আলোচনাও আছে।

সাইফুল আলম নিরব প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি পরিবহন খাতে চাঁদার নিয়ন্ত্রণ করছেন—এ কথা কোনো মালিক-শ্রমিক বলতে পারবেন না। পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণে বিএনপির তাঁর চেয়ে অনেক বড় নেতা জড়িত। তিনি বলেন, তিনি ২০০১ সালে মহাখালী থেকে একটি বাস চালাতেন। পরে সেটি বিক্রি করে দিয়েছেন। তেজগাঁওসহ অন্যান্য এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগকে তিনি অপপ্রচার বলে দাবি করেন।

দখলে যেসব এলাকা

তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের মালিক-শ্রমিক সূত্র বলছে, সরকার পরিবর্তনের পর সাইফুল আলম নিরবের লোকজন টার্মিনালের দুটি দোকান, তিনটি রেস্তোরাঁ ও একটি গোসলখানা দখলে নিয়েছেন। টার্মিনালে অবৈধভাবে তৈরি গোসলখানাগুলোয় প্রত্যেক শ্রমিকের কাছ থেকে গোসল বাবদ ১৫ টাকা, টয়লেট করলে ১০ টাকা ও প্রস্রাবের জন্য ৫ টাকা নেওয়া হয়। তেজগাঁও টার্মিনাল দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রণে ছিল শ্রমিকনেতা তালুকদার মনিরের। তিনি নিজেকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পালক ছেলে দাবি করতেন। এখন তিনি নিরবের সঙ্গে ভিড়ে গেছেন।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে সাদিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, সব জায়গায় এখনো তাঁদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চাঁদাবাজি বন্ধে তাঁরা চেষ্টা করছেন। সাইফুল আলম নিরবের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি বাস ব্যবসায়ী। মাঝখানে দূরে ছিলেন। এখন আবার বাস ব্যবসা করবেন। এতে তো অসুবিধা নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কারওয়ান বাজার মাছের আড়ত স্থানীয় যুবদলের এক শীর্ষ নেতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নেন সাইফুল আলম নিরব। তেজগাঁও এলাকার সব মসজিদে যাতে তাঁর লোকজনকে সভাপতি করা হয়, সে বিষয়ে চাপ দিচ্ছেন। বেগুনবাড়িতে যুবলীগের এক নেতার বাড়ি দখলের অভিযোগও উঠেছে নিরবের লোকজনের বিরুদ্ধে।

সাইফুল আলম নিরব

সওজে নিয়ন্ত্রণ

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) প্রধান কার্যালয় ও প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা অঞ্চলের কার্যালয় তেজগাঁও এলাকায়। সংস্থাটির ঢাকা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান সাবেক সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ডান হাত বলে পরিচিত ছিলেন। সরকার পরিবর্তন হলে সবুজ উদ্দিন কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিরোধের মুখে পড়েন শ্রমিক-কর্মচারীদের। এরপর তিনি সপ্তাহখানেকের বেশি কার্যালয়ে আসেননি। এ সময় সাইফুল ইসলাম নিরবের সঙ্গে বৈঠক করে সমঝোতার মাধ্যমে অফিস শুরু করেন বলে সওজে আলোচনা আছে। অবশ্য সবুজ উদ্দিন খানকে পরে একটি প্রকল্পে বদলি করা হয়েছে। এমনকি জালজালিয়াতির অভিযোগে সওজে ৪৭ ঠিকাদারকে কালোতালিকাভুক্ত করা হয়। তাদের আবার ফিরিয়ে আনার বিষয়েও সওজের প্রকৌশলীদের সঙ্গে সাইফুল আলম নিরব বৈঠক করেন বলে সূত্র জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আসাদুজ্জামান খান কামাল যেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করতেন, এর সবই সাইফুল আলম নিরবের অধীন চলে এসেছে। কোথাও কোথাও বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। মহাখালী ও তেজগাঁও টার্মিনালে আসাদুজ্জামান খানের লোকজনকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি করছেন তিনি।

সওজের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সওজের ঠিকাদারি কাজ বিএনপি ও এর
সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের দেওয়ার বিষয়ে চাপ দিচ্ছেন সাইফুল আলম। তিনি সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসানের সঙ্গেও গত মাসে সাক্ষাৎ করে নেতা-কর্মীদের দেখার অনুরোধ করেন।

এ বিষয়ে সাইফুল আলম নিরব প্রথম আলোকে বলেন, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের স্থানীয় নেতারা ব্যবসা করতে চান। তাঁরা গিয়েছিলেন। তিনি শুধু বলে দিয়েছেন, সম্ভব হলে তাঁদের যেন ব্যবসা দেন। এর বাইরে কোনো কর্মকর্তাকে রক্ষার উদ্দেশ্য ছিল না।

তবে সাদিকুর শ্রমিকনেতা হলেও এত দিন তিনি নিজেকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিতেন।সাদিকুর রহমান বিএনপির নেতৃত্বাধীন নতুন পরিবহন নেতাদের সঙ্গে ভিড়ে গেছেন।

মহাখালী টার্মিনালে যেভাবে চাঁদা আদায় হয়

মহাখালী টার্মিনালে প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার জন্য চাঁদা গুনতে হয়। এমনকি টার্মিনালের সামনে দিয়ে চলাচলকারী দূরপাল্লার বাস থেকেও তোলা হয় চাঁদা। টার্মিনালের সামনে বা আশপাশে দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলার সময় দিতে হয় চাঁদা। এ ছাড়া কোনো কোম্পানিতে নতুন বাস অন্তর্ভুক্তির জন্য লাগে চাঁদা।

আওয়ামী লীগের বিগত প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে যৌথভাবে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হতো। এখনো তা অব্যাহত আছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই চাঁদার নিয়ন্ত্রণ করছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সাদিকুর রহমান (হিরু)। তিনি মহাখালী বাস টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়নেরও সভাপতি। তবে সাদিকুর শ্রমিকনেতা হলেও এত দিন তিনি নিজেকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিতেন।

মহাখালী বাস টার্মিনাল ও পরিবহন খাতের সূত্রগুলো বলছে, বিগত সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগপন্থী পরিবহন নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে সাদিকুর রহমান বিএনপির নেতৃত্বাধীন নতুন পরিবহন নেতাদের সঙ্গে ভিড়ে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হবে না—এমন আশ্বাস দেন সাইফুল আলম নিরব। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে কিছুটা আড়ালে চলে যান সাদিকুর রহমান।

তবে সরকার পরিবর্তনের পর এনা পরিবহন আর চলছে না। এই কোম্পানির অধীন চলাচলকারী অনেক বাস ইউনাইটেড নামে ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে চলাচল করছে।

সূত্রগুলো জানায়, মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার বাস চলাচল করে। আরও শ পাঁচেক বাস আশপাশের সড়ক থেকে চলে। এগুলোর গন্তব্য উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চল। এর মধ্যে একতা পরিবহন, এনা পরিবহন ও সৌখিন পরিবহনের বাস সবচেয়ে বেশি। তবে সরকার পরিবর্তনের পর এনা পরিবহন আর চলছে না। এই কোম্পানির অধীন চলাচলকারী অনেক বাস ইউনাইটেড নামে ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে চলাচল করছে।

সাদিকুর রহমান শ্রমিকনেতা হলেও এনা পরিবহন, সৌখিন পরিবহন, একতা পরিবহন, সোনার বাংলা, শাহজালাল পরিবহন, রাজীব পরিবহন, শ্যামলী বাংলা পরিবহন, বিনিময় পরিবহনসহ বিভিন্ন কোম্পানির অধীন ৬০-৬৫টি বাস পরিচালনা করে আসছিলেন। এসব বাস নিজের নয়, বরং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পরিবারের সদস্যদের বলে প্রচার করতেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর একান্তে আলাপের অনেক ছবিও ঘুরছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের হাতে হাতে। এখন সাদিকুরের এসব বাস পরিবহন নেতা সাইফুল আলম ও সাইফুল আলম নিরবের অধীন চলে গেছে।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে সাদিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল আলম বলেন, সব জায়গায় এখনো তাঁদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। চাঁদাবাজি বন্ধে তাঁরা চেষ্টা করছেন। সাইফুল আলম নিরবের বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি বাস ব্যবসায়ী। মাঝখানে দূরে ছিলেন। এখন আবার বাস ব্যবসা করবেন। এতে তো অসুবিধা নেই।

এখন সাদিকুরের এসব বাস পরিবহন নেতা সাইফুল আলম ও সাইফুল আলম নিরবের অধীন চলে গেছে।