চারদিকে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, স্বার্থপরতা—এত কিছুর মধ্যেও হতাশ না হয়ে কেন তিনি আশাবাদী, সে গল্প নিজের ৮৯তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শুনিয়েছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
আজ শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শিশু একাডেমি মিলনায়তনে ‘ফিরে দেখা’ শিরোনামে আত্মজৈবনিক বক্তব্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ যখন ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার হন, তখন কিছু লোক মুঠোফোনে ছবি তুলছিলেন। একজন ভিডিও করছিলেন। পরে বলতে পারবেন এ ঘটনার তাঁরাও সাক্ষী। কিন্তু এসবের মধ্যে না গিয়ে আরেকজন লোক সাহায্য করতে ছুটে এলেন। সিএনজি (অটোরিকশা) ডেকে আনলেন এবং আনু মুহাম্মদকে সিএনজিতে তুলতে সাহায্য করলেন। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন সেই ব্যক্তি। ওই ব্যক্তি জানতেনও না, আনু মুহাম্মদ কে।
এই যে মানুষ আছে, মনুষ্যত্ব আছে—এ কারণেই চারদিকে নানা হতাশার মধ্যেও আশা দেখেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, মানুষের ওপর আস্থা রাখতেই হবে। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় (গত ২১ এপ্রিল) দুই পায়ে গুরুতর জখম হওয়া আনু মুহাম্মদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা ওই ব্যক্তি (নাম বলেননি) পুরান ঢাকার একজন মানুষ, মসলার ব্যবসা করেন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত ত্রৈমাসিক নতুন দিগন্ত পত্রিকা আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনের অনেকে বক্তব্য দেন। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর বক্তব্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উদ্দেশে বলেন, ‘যন্ত্র হতাশ হয় না, কিন্তু মানুষ মাত্রই হতাশ হয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কেন হতাশ হন না?’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক নৈতিকতা, তা সর্বকালের সর্বনিম্ন স্তরে আছে। বিশেষ করে যখন দেখেন, আপনার (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) বিভাগেরই ছাত্র শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে স্বীকৃত হয়, তখন হতাশ হন না স্যার?’
পরে নিজের বক্তব্যে কেন তিনি আশাবাদী থাকেন, সেই গল্প শোনান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আশাবাদী হওয়ার আরও দুটি কারণ উল্লেখ করেন তিনি বলেন, আশাবাদের কারণ হচ্ছে মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন না দেখলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। আর তরুণদের মধ্যে যে তারুণ্য দেখা যায়, সেটা দেখেও আশাবাদ তৈরি হয়। তারা এখনো এই বিরূপ পরিবেশের মধ্যে প্রতিবাদ করে। তারুণ্যকে রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ভয় পায়। তারুণ্য নষ্ট করার জন্য যত রকম কায়দা আছে, সব করা হচ্ছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ব্যবস্থা এ রকম হয়ে গেছে যে সেই ব্যবস্থা মানুষকে মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। মনুষ্যত্ব কেড়ে নিচ্ছে। মানুষ বিকশিত হয় সামাজিকভাবে। সেই সামাজিকতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যত উন্নতি হচ্ছে, তত বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যত উন্নতি হচ্ছে, তত বৈষম্যও বাড়ছে। বেকারত্ব বৃদ্ধি, বৈষম্য বৃদ্ধি, বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি—সব কিছুই পুঁজিবাদী উন্নতির লক্ষণ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই ভূখণ্ডে তিনটি রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখেছেন—ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও কিন্তু ঔপনিবেশিকতা রয়ে গেছে। উপনিবেশ শাসনের কী চরিত্র, সেটা তো জানা। তারা লুণ্ঠন করেছে, শোষণ করেছে। এই লুণ্ঠন ও শোষণের মধ্য দিয়ে তারা যা পেত, সেটা পাচার করত। বাংলাদেশেও সেই ঘটনা চলছে। সেটি ঘটছে ব্যাংক লুণ্ঠন, ভূমিদস্যুতা, নদীদস্যুতা, বৃক্ষদস্যুতা—নানা রঙের দস্যুতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেই লুণ্ঠন ও দস্যুতার টাকা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি এ এস এম কামালউদ্দিন। সঞ্চালক ছিলেন অধ্যাপক আজফার হোসেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদের উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায় একদল শিশু। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে ছিল কবিতা আবৃত্তি, গান ও নৃত্য পরিবেশনা।