পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি নিয়ে ১১ গুজব শনাক্ত করেছে রিউমার স্ক্যানার
পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার। এই সংকট নিয়ে তারা এখন পর্যন্ত ১১টি গুজব শনাক্ত করেছে।
গত বুধবার খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক বাঙালি যুবকের মৃত্যু হয়। এর জের ধরে ওই দিন সেখানকার পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এই সংঘাত খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ–সহিংসতায় পার্বত্য এই দুই জেলায় ৪ জন নিহত এবং অন্তত ৮০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
রিউমার স্ক্যানারের তথ্য অনুযায়ী, ২০ সেপ্টেম্বর বেশ কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের সঙ্গে অস্ত্র হাতে পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তির ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়, ছবিটি সম্প্রতি পার্বত্য এলাকার দৃশ্য। তবে রিউমার স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ছবিটি পার্বত্য এলাকার নয়। রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত একজন কয়েদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ১৬ আগস্ট শুক্রবার কারাগারে উত্তেজনা শুরু হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে যায় সেনাবাহিনীর একটি দল। সে সময়ের ছবি এটি। তবে অস্ত্র হাতে পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ–সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সে সময় সাধারণ পোশাকে থাকা একাধিক ব্যক্তির হাতেই অস্ত্র ছিল। এই কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক রিউমার স্ক্যানারকে বলেছেন, এই ব্যক্তির নাম মো. মিজানুর রহমান। তিনি কারারক্ষী হিসেবে রংপুর কারাগারে কর্মরত রয়েছেন।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হ্যাশট্যাগ দিয়ে কিছু ফেসবুক পোস্টে জঙ্গলের মতো এলাকায় কিছু পাহাড়ি ব্যক্তির জড়ো হয়ে বসে থাকার দৃশ্য যুক্ত করে দাবি করা হয়, ‘অনেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। না জানি আজ রাতে আরও কতজনের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, কতজনকে হত্যা করা হয়। সে জন্য এরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।’ রিউমার স্ক্যানার বলছে, এই ছবি চলতি বছরের অন্তত মে মাস থেকে ইন্টারনেটে রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এ গত ১৯ মে এই ছবিসহ একটি পোস্ট পাওয়া যায়।
অপতথ্যের এই প্রবাহে ধর্মীয় স্থাপনাসংক্রান্ত ভুল তথ্যের প্রচারও থেমে নেই বলেও উল্লেখ করেছে রিউমার স্ক্যানার। নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন একটি পোড়া মূর্তির ছবি এক্স–এ পোস্ট করে এটিকে খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক দৃশ্য বলে দাবি করেছেন। একইভাবে ‘সনাতন মহাকাব্য’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে একই ছবি পোস্ট করে রাঙামাটির দৃশ্য বলে দাবি করা হয়।
রিউমার স্ক্যানার বলছে, ভাইরাল ছবিটি অন্তত চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ইন্টারনেটে রয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি এ–সংক্রান্ত একাধিক পোস্ট পাওয়া যায়, যেখানে দাবি করা হচ্ছে এটি ৬ জানুয়ারির ঘটনা। সেদিন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শরনংকর ভিক্ষুর মন্দির জ্ঞানশরণ মহারণ্য বৌদ্ধবিহার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
পাহাড়ি ব্যক্তিরা অস্ত্রসহ রাস্তা পার হচ্ছে—এমন দাবিতে দুটি ভিডিও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুকে। রিউমার স্ক্যানার অনুসন্ধানে দেখেছে, ভিডিও দুটি ফিলিপাইনের। ‘সাত্তার জাক্কাল’ নামের একটি ফেসবুক পেজে এই দুই ভিডিও ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। পেজটি ফিলিপাইন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তা ছাড়া ভিডিওর বিভিন্ন উপাদান (গাড়ির নম্বরপ্লেট, গ্যাস স্টেশনের নাম, মোবাইল পেমেন্ট পরিষেবা জিক্যাশের ব্যানার) বিশ্লেষণ এবং পরে যাচাই করে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভিডিও দুটি ফিলিপাইনেরই।
অস্ত্র হাতে আরও কিছু ব্যক্তির ভিন্ন আরেকটি ভিডিওকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউবে। তবে রিউমার স্ক্যানার অনুসন্ধান করে দেখেছে, ভিডিওটি ভারতের আসামের। ভিডিওটির অগ্রভাগে যাঁকে দেখা যাচ্ছে, তাঁর নাম সামবোর রংপি। তিনি আসামের একজন পুলিশ সদস্য। তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১৭ জুলাই মূল ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। একই ব্যক্তি ৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেন তাঁর অ্যাকাউন্টে। এটিকেও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দাবিতে গতকাল প্রচার করা হয়েছে ফেসবুকে।
রাঙামাটিতে মার্কিন সেনারা ঢুকে পড়ছেন, এমন দাবিতে একটি ভিডিও প্রচার হতে দেখেছে রিউমার স্ক্যানার। যাচাই করে দেখা গেছে, এই ভিডিও সাম্প্রতিক সময়ের নয়। ভিডিওটি এক্সে গত ৩০ মে বায়োতে ফ্রান্স উল্লেখ আছে এমন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়। তবে ভিডিওটির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি। যদিও এটা নিশ্চিত যে এটি বাংলাদেশের বা সাম্প্রতিক সময়ের ভিডিও নয়।
বর্তমানে রাঙামাটির অবস্থা দাবি করে একটি ছবি পোস্ট হচ্ছে ফেসবুকের একাধিক অ্যাকাউন্টে। তবে রিউমার স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ছবিটি মিয়ানমারের। গত সপ্তাহে দেশটির একটি গ্রামে কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি (কেআইএ) এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় এই আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
দেশের যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে মৃত্যুর গুজব একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের সাম্প্রতিক সংকটেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। আইনজীবী নিঝুম মজুমদার, আওয়ামী যুব মহিলা লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইয়াসমিন সুলতানাসহ একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে জেনার চাকমা নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পুরোনো পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের তিন (জেনার চাকমা) নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
তবে রিউমার স্ক্যানারকে জেনার চাকমা নিশ্চিত করেছেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। তিনি সুস্থ আছেন এবং বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।