বিদ্যুৎ খাতে প্রাধান্য পাচ্ছে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ

জ্বালানি রূপান্তর নীতির খসড়া প্রস্তাব নিয়ে নাগরিক সংলাপে বক্তারা। সিরডাপ মিলনায়তনে এই সংলাপের আয়োজন করে ক্যাব। ঢাকা, ৩০ জুনছবি: দীপু মালাকার

যেকোনো অবকাঠামো খাতের তুলনায় বিদ্যুৎ খাতটিতে নগদ অর্থ সৃষ্টির সুযোগ অনেক বেশি। অশুভ লুণ্ঠনমূলক আয়ও যেকোনো খাতের চেয়ে বেশি। অলিগার্কের (বিশেষ গোষ্ঠী) পছন্দের কিছু বণিকের স্বার্থ সমৃদ্ধ করতে চাহিদাকে আমলে না নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এভাবে সক্ষমতা না বাড়ালে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয় নিয়ন্ত্রণে থাকত।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণে জ্বালানি সুবিচার প্রতিষ্ঠার দাবি করেছে সংগঠনটি। এটি সামনে রেখে বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতির একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে গতকাল রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে নাগরিক সংলাপ করেছে তারা।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, মানুষের জীবনমান উন্নত হবে না। তাই জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি প্রয়োজন। জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা তৈরি করতে হবে। ব্যবসা আর রাজনীতির একটা সখ্য গড়ে উঠেছে, যেটা সব সময় জনস্বার্থ রক্ষা করছে না। এটি জনকল্যাণে কাজ করছে না।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) ২০১০–এর সমালোচনা করে এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে ক্যাব। তারা বলছে, এই আইন ভোক্তাকে তার ন্যায্য জ্বালানি অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। এ খাতে লুণ্ঠন অব্যাহত রাখতে এটি একটি সনদে পরিণত হয়েছে। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, জ্বালানিস্বল্পতার কারণে সব কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত। জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত। আর্থিক প্রবৃদ্ধি নিম্নগামী। জ্বালানি বিতরণ ও বণ্টনে গ্রামাঞ্চল বৈষম্যের শিকার।

ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম বলেন, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিজ্ঞজনদের কথা শোনেন না। তাই তাঁরা দেশি গ্যাসের অনুসন্ধান ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় জোর দেননি। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হলে দেশে অনেক গ্যাস পাওয়া যেত। এসব না করে সহজ পথ হিসেবে এলএনজি আমদানির দিকে গেছেন। এটি এখন অর্থনৈতিক বোঝা তৈরি করেছে।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, গত এক দশকে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে অবহেলা করা হয়েছে। এখন কূপ খননের প্রকল্প নিয়েছে, কিন্তু টাকা বরাদ্দ হয়নি। আর বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা বুঝে কেন্দ্র তৈরি করা হয়নি। যে ব্রিফকেস নিয়ে আসছে, তারেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত কাদায় পড়ে গেছে, এটিকে কাদা থেকে বের করে আনতে হবে।

ক্যাবের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, একজন ব্যক্তি বছরে মাথাপিছু রান্নার জন্য ৩৫ কেজি এলপিজি ও ১২০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুবিধা না পেলে তাকে জ্বালানি দরিদ্র বলা যাবে। জ্বালানি দারিদ্র্য কার্যত জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতারই বহিঃপ্রকাশ। যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি জ্বালানি দারিদ্র্য রোধ করে না, বরং বাড়ায়; সে প্রক্রিয়ার উন্নয়ন কোনোভাবেই জাতীয় প্রত্যাশা নয়। এটা অলিগার্কদের প্রত্যাশা।

লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। এতে বলা হয়, মূল্যহার নির্ধারণের ক্ষমতা সরকার নিজের হাতে নেওয়ায় সরবরাহ ব্যয় ও মূল্যহার উভয়ই অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধির কারণে মূল্যহার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকায় ভোক্তা জ্বালানি অধিকারবঞ্চিত ও জ্বালানি দারিদ্র্যের শিকার।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, জ্বালানি খাতকে পঙ্গু করার পেছনে ভূমিকা রাখতে ওই একটি আইন যথেষ্ট, এটি হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন। আবার সরকার বিইআরসি আইন সংশোধন করে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়েছে। এটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী, তাই এটা বাতিল করতে হবে। মূল্য নির্ধারণে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। ভোক্তাকে সস্তায় মানসম্মত জ্বালানি দিতে হবে, ইচ্ছেমতো দামে নয়।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, চাহিদা না বুঝে বিদ্যুৎ–সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে অলিগার্ক তৈরি করতে। তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ (কেন্দ্র ভাড়া) দিয়ে শীর্ষ ধনীর কাতারে উঠিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্র এমন বোকা নীতি গ্রহণ করতে পারে, ভাবা যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা) ঘিরে যে অলিগার্ক তৈরি হয়েছে, তাতে জ্বালানি রূপান্তর কঠিন। নাগরিক সংলাপ সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক শুভ কিবরিয়া।