মুক্তির মন্দির সোপান তলে

এরকম অকুতোভয় তরুণদের আত্মদান ত্বরান্বিত করেছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতন

চট্টগ্রাম। প্রাচীন এই শহরের আরেকটি নাম বীর চট্টলা। বীরদের এই শহরের মাটির প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে মুক্তির সুর। যুগে যুগে নগরের মানুষ বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, লড়াই করে তৈরি করেছে প্রতিরোধের ইতিহাস।

২০২৪ সালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম প্রতিরোধও গড়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম থেকেই। আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে নগরের মানুষ তুলে ধরেছিল নিজেদের কণ্ঠস্বর। জানিয়ে দিয়েছিল অন্যায়ের কাছে সূর্যসেন, প্রীতিলতার ভূমির মানুষ মাথা নত করবে না। গত ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে প্রাণ দেন অন্তত ১০ জন। অস্ত্রের সামনে প্রতিরোধ গড়ে প্রাণ দেওয়া ওয়াসিম, হৃদয়, ফয়সাল, তানভীর, কাউসাররা এবারের সূর্যসেন। এই বীরদের আত্মদানের স্মৃতি যেমন শোকার্ত করে, তেমনি স্বপ্ন ও সাহসের বীজ বোনে আমাদের হৃদয়ে।

  স্বপ্নবাজ ওয়াসিম

মোহাম্মদ ওয়াসিম, কক্সবাজারের পেকুয়ার এক স্বপ্নবাজ তরুণ। স্বপ্ন দেখতেন দেশমুক্তির, স্বপ্ন দেখতেন সমাজ পরিবর্তনের। তবে এই স্বপ্নপূরণ নিজের চোখে দেখা হলো না তাঁর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে ছাত্রলীগ-যুলীগের গুলিতে প্রাণ হারান তিনি।

পেকুয়ার সদর ইউনিয়নের বাঘগুজারা বাজারপাড়া এলাকার সৌদিপ্রবাসী শফিউল আলমের ছেলে ওয়াসিম। চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পাশাপাশি ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সংগঠনটির চট্টগ্রাম কলেজ শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক পদে ছিলেন তিনি।

ওয়াসিম যখন গুলিবদ্ধ হন তখন পাশেই ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওয়াসিম ছিলেন দুরন্ত সাহসী। শুরু থেকেই ছাত্রদলের সব কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন আওয়ামী লীগের পতনের। স্বপ্ন দেখতেন স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির। ওয়াসিমের মতো সাহসী স্বপ্নবাজদের জন্যই দেশ আজ স্বৈরাচারমুক্ত।’

দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ওয়াসিম ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন, এ শঙ্কায় মা–বাবাকে কর্মসূচির কথা জানাতেন না ওয়াসিম। ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দেখে বোনেরা বুঝতেন ভাই রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন। তাই বোনদের কাছে লুকাতেন না তিনি। ওয়াসিমের ছোট বোন রশ্মি আক্তার বলেন, ‘ভাইকে কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা নিষেধ করতাম। তবে ভাই আমাদের অভয় দিয়ে বলতেন, “আমাদের মুক্তি দরকার। ঘরে বসে থাকলে মুক্তি আসবে না। শান্তি আসবে না।”’

রশ্মি আক্তার বলেন, ‘ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। কিন্তু ভাই সেটি দেখে যেতে পারলেন না। আমরা আর ভাইকে দেখতে পাব না, মনে হলেই চোখ ভিজে যায়।’

  পরিবারের মুখে হাসি দেখতে চেয়েছিলেন হৃদয়

পুরো নাম হৃদয় চন্দ্র তরুয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলার ঘটকের আন্দুয়া গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে হৃদয়। বাবা রতন চন্দ্র তরুয়া পেশায় কাঠমিস্ত্রি। আর মা অর্চনা রানী ছিলেন গৃহকর্মী। এককথায় পরিবারের অভাব–অনটন দেখেই বড় হয়েছিলেন তিনি।

অন্য পাঁচটা দরিদ্র পরিবারের সন্তানের মতো হৃদয়ের স্বপ্নও ছিল সাধারণ। পড়াশোনা করবেন, চাকরি করবেন, পরিবারের অভাব–অনটন দূর করবেন, এটিই যেন ছিল তাঁর একমাত্র চাওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর থেকে টিউশনের টাকা দিয়েই চলতেন তিনি। মা–বাবার মুখে হাসি ফোটাতে বিভিন্ন সময় এ টাকা দিয়েই উপহারও কিনে নিতেন।

প্রায় তিন বছরের এই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন সহপাঠী হারুন অর রশিদ। তাঁরা দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে থাকতেন। হারুন অর রশিদ বলেন, ‘হৃদয়ের একমাত্র স্বপ্ন ছিল পরিবারে মুখে হাসি ফোটানো। দ্রুত চাকরি পাওয়া ছাড়া এর বিকল্প নেই। টিউশনি শেষে যখনই সুযোগ পেত বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করত। এ কারণে যখনই কোটা বহালের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তখন থেকেই ক্ষোভে ফুঁসেছে হৃদয়। প্রতিটি আন্দোলনেও অংশ নিয়েছিল।’

হৃদয়ের পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা কিছুটা কমেছে। একমাত্র বোন মিতু রানীকে চাকরি দিয়েছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাবাকেও অনেকেই আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। হৃদয়ের ভগ্নিপতি দীপক চন্দ্র তরুয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘হৃদয় সব সময় পরিবার নিয়ে ভাবতেন। সবাইকে অভয় দিয়ে অসচ্ছলতা দূর করার আশ্বাস দিতেন। তবে আশ্বাস দেওয়া ব্যক্তিটা আর নেই। এই শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়।’

শান্ত ছেলেটি আর বাসায় ফিরবে না

দিনটি ছিল ১৬ জুলাই। দুপুরে মায়ের কাছ থেকে মুরাদপুর যাচ্ছেন বলে বিদায় নেন সদ্য স্নাতকে ভর্তি হওয়া তরুণ ফয়সাল আহমেদ। মায়ের কাছে ঘরের চাবিটাও দিয়ে এসেছিলেন তিনি। তবে স্কুলশিক্ষক মা কহিনুর আক্তারের কাছে তখনো অজানা তাঁর শান্ত ছেলেটি আর বাসায় ফিরবেন না। ওই দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি।

ফয়সাল আহমেদ চট্টগ্রামের ওমর গণি এমইএস কলেজে বিবিএ অনুষদের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। চলতি বছরের মার্চে তিনি সেখানে ভর্তি হয়েছিলেন। এর আগে বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন তিনি। মা আর ছোট বোন সুমাইয়াকে নিয়ে নগরের ইপিজেড এলাকায় থাকতেন ফয়সাল। তাঁর বাবা মো. জাকির হোসেন বরিশালেই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেখানেই তিনি থাকেন।

তিন দিন পর লাশ পাওয়া যায় মর্গে

নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় মুদির দোকানে কাজ করতেন সাইমন। গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংঘাত চলাকালে নিখোঁজ হন। ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার। ওই দিনের পর থেকে খালা নাঈমা বেগম নগরের বিভিন্ন জায়গায় সাইমনের সন্ধান করেন। তবে কোথাও পাননি। তিন দিন খোঁজার পর অবশেষে ২০ জুলাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সাইমনের লাশ শনাক্ত করেন তিনি। সন্তান হারানোর শোক আর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেটিকে হারিয়ে দিশাহারা ছিলেন তাঁর মা রহিমা বেগম। তবে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রহিমা বেগমের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার। গত সেপ্টম্বরে বড় ভাই তুশিন চাকরি পেয়েছেন। গত ১৮ অক্টোবর রহিমা বেগমের কাছে প্রথম মাসের বেতনের চেক হস্তান্তর করেছেন সন্দীপ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রিগ্যান চাকমা।

আড়াই মাস যুদ্ধের পর হার মানেন কাউসার

চট্টগ্রাম বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী কাউসার মাহমুদ। গত ৪ আগস্ট সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে গিয়ে আহত হয়েছিলেন তিনি। ওই দিন নগরের নিউমার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীরা। ওই হামলার প্রায় ২ মাস ১০ দিন যুদ্ধের পর মৃত্যুর কাছে হার মানেন কাউসার।

কাউসার মাহমুদের পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলায়। তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরে মোগলটুলী এলাকায়। সেখানে মা, বাবা ও চার ভাইবোন মিলে ভাড়া বাসায় থাকতেন তাঁরা। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে কাউসার ছিলেন সবার বড়। গত ১৪ অক্টোবর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কাউসার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সর্বশেষ শহীদ তিনি।