মামলা না করেই লিগ্যাল এইডে বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ

প্রতীকী ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরের বাসিন্দা ফারহানা আফরোজ। বিয়ের বছরখানেকের মাথায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিচ্ছেদ হয় তাঁর। তবে স্বামী তৌহিদুল ইসলাম দেনমোহরের আড়াই লাখ টাকা পরিশোধ করেননি। পরিবার ও পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন ফারহানা। কিন্তু কোনোভাবেই টাকা পাননি। মামলা পরিচালনার মতো আর্থিক সংগতিও নেই এই নারীর।

অগত্যা চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইডের (জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা) দ্বারস্থ হন ফারহানা। গত নভেম্বরের মাঝামাঝি পরিচিত কয়েকজনের পরামর্শে লিগ্যাল এইডে একটি আবেদন করেন তিনি। এই আবেদনে সাবেক স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহরের টাকা পেতে সহায়তা চাওয়া হয়।

আবেদনের মাত্র ২৭ দিনের মধ্যে সমস্যার সমাধান হয়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর—অলটারনেটিভ ডিসপিউট রেজল্যুশন) মাধ্যমে দেনমোহরের আড়াই লাখ টাকা বুঝে পান ফারহানা। সঙ্গে আরও পান ইদ্দতকালীন ভরণপোষণ বাবদ ৬০ হাজার টাকা।

শুধু ফারহানা নন, তাঁর মতো অনেক অসহায় বিচারপ্রার্থীর ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) শাহনেওয়াজ মনির প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন ৬০ থেকে ৬৫ জন আইনি সহায়তা নিতে আসেন। তাঁদের অর্ধেকই নারী।

সহায়তাপ্রত্যাশীদের কীভাবে সহায়তা করে লিগ্যাল এইড—এমন প্রশ্নের জবাবে শাহনেওয়াজ মনির বলেন, অভিযোগ আসার পর গুরুত্ব বুঝে প্রথমে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। এতে ফল পাওয়া না গেলে ভুক্তভোগীর পক্ষে মামলা করা হয়।

বিনা খরচে আইনি সহায়তা পেতে জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে দরিদ্র ও অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। এখান থেকে বিচারপ্রার্থীদের ফৌজদারি, দেওয়ানি, পারিবারিক ঝামেলায় আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
শাহনেওয়াজ মনির, চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার।

আজ শুক্রবার জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। দিবসটির প্রাক্কালে শাহনেওয়াজ মনির আরও বলেন, বিনা খরচে আইনি সহায়তা পেতে জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে দরিদ্র ও অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীদের সংখ্যা বাড়ছে। এখান থেকে বিচারপ্রার্থীদের ফৌজদারি, দেওয়ানি, পারিবারিক ঝামেলায় আইনি সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অনেককেই আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মীমাংসায় উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

গত ৩ মাসে ৫২ আবেদন

২০০০ সালে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান’ আইন করা হয়। এই আইন অনুসারে, ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা গঠন করা হয়। তবে জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবসহ নানা কারণে সূচনাকাল থেকে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম ছিল স্থবির। ২০১১ সালে চট্টগ্রামে জেলা লিগ্যাল এইডের কার্যালয়ের কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয়। 

চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইডের অফিস সহকারী এরশাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নারীরা সাধারণত স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে যৌতুক দাবি, নির্যাতন, দেনমোহর ও ভরণপোষণ না দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে আসেন। বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মীমাংসার চেষ্টা করা হয়।

চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আইনি সহায়তা পেতে ২০১৫ সালে আবেদন জমা পড়েছিল ১ হাজার ৪২৪টি। নিষ্পত্তি হয়েছিল ৩০০টি। পরের বছর আবেদনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ১৫২। নিষ্পত্তি হয় ৬৬৩টি আবেদনের। ২০১৭ সালে ৬৬৪টি আবেদনের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৫৭৬টি।

লিগ্যাল এইডে কার্যালয়ে ছোটখাটো অনেক বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়া হয়। আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাই আদালতে অপ্রয়োজনীয় মামলাজট কম হয়।
নাজিম উদ্দিন চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি।

২০১৮ সালে চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে আবেদন জমা পড়ে ৪৫৬টি। নিষ্পত্তি হয় ৪২১টি। পরের বছর ৭০০ আবেদনের মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১৯৩টি। ২০২০ সালে ৪০৩টির মধ্যে ৯৩টি এবং ২০২১ সালে ৫৬৬টির মধ্যে ১৩৯টি আবেদন নিষ্পত্তি হয়। আর গত বছর নিষ্পত্তি হয় ১৬০টি আবেদন। জমা পড়েছিল ৮১৮টি আবেদন।

অন্যদিকে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) আবেদন জমা পড়েছে মোট ৫২টি। এ সময় বিরোধ মীমাংসা করে ১০ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আবেদনকারীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৭৫ লাখ ১১ হাজার টাকা।

যার যত অভিযোগ

চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ছয়তলায় জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়। মামলা পরিচালনার জন্য এখানে ১০৮ আইনজীবী রয়েছেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে গিয়ে ১৬ বিচারপ্রার্থীর দেখা মেলে। তাঁদের মধ্যে একজন নারী (নাম গোপন রাখা হয়েছে) এসেছেন হাটহাজারী থেকে। প্রথম আলোকে ওই নারী বলেন, দুই বছর আগে পারিবারিকভাবে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। এক বছরের একটি ছেলেসন্তানও রয়েছে। বিয়ের পর থেকে শ্বশুরবাড়ির লোকজন যৌতুকের দাবিতে তাঁকে নির্যাতন করে আসছিলেন।

ওই নারী আরও বলেন, নির্যাতন থেকে বাঁচতে লিগ্যাল এইডে সহায়তা চেয়ে আবেদন করেন তিনি। গত মাসে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। উপস্থিত হয়ে তাঁরা (ওই নারীর শ্বশুরবাড়ির লোকজন) নির্যাতন না করার অঙ্গীকার করেন। এর পর থেকে তিনি ভালো আছেন। ভালোভাবে সংসার করছেন। এটা জানাতে লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে এসেছেন তিনি।  

আরও পড়ুন

নিষ্পত্তি হয় লেনদেন নিয়ে বিরোধ

শুধু পারিবারিক ঝামেলা নয়, লেনদেনসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয় চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইডে। নগরের আগ্রাবাদ এলাকার নাজির আকন ও মাসউদুর রহমান প্রতিবেশী ও বন্ধু। মাসউদুর রহমানের কাছে নাজির আকনের পাওনা ছিল ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা আগে পরিশোধ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা আদায়ে লিগ্যাল এইডে আবেদন করা হয়েছিল। ১৮ এপ্রিল দুই পক্ষকে কার্যালয়ে ডেকে মীমাংসা করে দেওয়া হয়। ওই দিন বিকেলে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা আগামী বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি পরিশোধ করার অঙ্গীকার করেন মাসউদুর রহমান।

এ বিষয়ে নাজির আকন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতে মামলা করলে এত কম সময়ে টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তাই লিগ্যাল এইডের সহায়তা নিয়েছি।’

আরও পড়ুন

কমবে মামলাজট

লিগ্যাল এইডের এ সেবা আদালতে মামলাজট কমাতে সহায়তা করবে বলে আশা করছেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরী।

নাজিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক সামর্থ্য না থাকা বিচারপ্রার্থীরা যাতে বিনা খরচে আইনি সহায়তা পান, সে জন্য আইনজীবীরা ভুক্তভোগীদের লিগ্যাল এইড কিংবা ব্লাস্টে পাঠাতে পারেন। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সমাজের সচেতন মানুষেরা অসহায় মানুষকে লিগ্যাল এইডে পাঠাতে পারেন।

নাজিম উদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে ছোটখাটো অনেক বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়া হয়। আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। তাই আদালতে অপ্রয়োজনীয় মামলাজট কম হয়।