ভবনের অনিয়ম চাপা পড়ে কর্মকর্তারা ‘খুশি’ থাকলে
ভবন নির্মাণের অনুমোদন, নির্মাণের পর ব্যবহার, অগ্নিনিরাপত্তার সনদ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি—এসব ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকিতে ঘাটতি আছে।
কোনো ভবন ব্যবহার করার আগে রাজউকের কাছ থেকে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট বা ব্যবহার সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর কারণ রাজউকের অনুমোদন নিয়ে নির্মাণের পরও একটি ভবন ব্যবহারবিধি সঠিকভাবে না মানলে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বেইলি রোডে আগুনে প্রাণহানি ঘটা ভবনটির অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছিল না। ভবনটিতে রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য দোকান চালুর অনুমতিও ছিল না। অভিযোগ উঠেছে, ওই ভবনে সবই চলছিল রাজউকসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের ‘খুশি’ (অনৈতিক সুবিধা দিয়ে) রেখে।
আইন অনুযায়ী কোনো ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না থাকলে সেই ভবনের ফায়ার লাইসেন্স (অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত সনদ) পাওয়ার সুযোগ নেই। একইভাবে সেই ভবনে থাকা কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরও ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যবসার অনুমতিপত্র পাওয়ার কথা নয়।
অকুপেন্সি সার্টিফিকেট দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ফায়ার লাইসেন্স দেয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। আর ট্রেড লাইসেন্স দেয় সিটি করপোরেশন।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছিল না। এই ভবনে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর রমনা থানায় পুলিশ যে মামলা করেছে, তাতে বলা হয়েছে, রাজউকের দোকান–পরিদর্শকদের ‘ম্যানেজ’ করে সেখানে রেস্তোরাঁ ব্যবসা (আটটি রেস্তোরাঁ, চা-কফিসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান ছিল) চলছিল।
অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছাড়াই ভবনটিকে ফায়ার লাইসেন্স দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রেস্তোরাঁসহ অন্য দোকানগুলোকে ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছে।
নগর–পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেন, আটতলা গ্রিন কোজি কটেজ ভবন নির্মাণের পর এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, সেই তদারকির মূল দায়িত্ব ছিল রাজউকের। তাদের অবহেলা ও তদারকিতে বড় ধরনের গাফিলতি রয়েছে।
এখন পর্যন্ত রাজউক একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়নি। এ ঘটনায় দায় নিতে হবে ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকেও (বেইলি রোড এলাকা ঢাকা দক্ষিণের আওতাধীন)। তাদেরও দায়িত্বে অবহেলা ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কর্মকর্তাদের ‘খুশি’ রাখতে পারলে অনিয়ম ঢেকে রাখা যায়।
বেইলি রোডে আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে পুলিশ, রাজউক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন—যে যার মতো করে অভিযান চালাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের অভিযানে যুক্ত থাকছে ফায়ার সার্ভিস। এসব অভিযানে দেখা যাচ্ছে, নির্মাণের শর্ত ভঙ্গ করেই বিভিন্ন ভবনে রেস্তোরাঁ চালু করা হয়েছে।
অনুমোদনহীন ভবনে ব্যবসা ‘ম্যানেজ’ করে
একটি রেস্তোরাঁ চালু করার জন্য অন্তত ১০টি অনাপত্তিপত্র প্রয়োজন। এর মধ্যে লাইসেন্স নিতে হয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে, ব্যবসার অনাপত্তিপত্রসহ তিনটি সনদ নিতে হয় সিটি করপোরেশন থেকে, ফায়ার লাইসেন্স নিতে হয় ফায়ার সার্ভিস থেকে, অবস্থানগত ছাড়পত্র নিতে হয় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে, বাণিজি৵ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স নিতে হয় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন সনদ নিতে হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে। এ ছাড়া সিভিল সার্জনের কার্যালয় থেকে সনদ নিতে হয়। এর বাইরে দই ও বোরহানির মতো বোতল বা প্যাকেটজাত খাদ্যপণ্য কোনো রেস্তোঁরা বিক্রি করলে সরকারি আরেকটি সংস্থা বিএসটিআইয়ের সনদ নিতে হয়।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট আছে নাকি নেই সেটি অনেক ক্ষেত্রেই জানার বা দেখার উপায় থাকে না। ভবনমালিকদের মুখের কথা বিশ্বাস করতে হয়। একটি রেঁস্তোরার চালু করতে হলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার ১০টির বেশি সনদ লাগে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে এগুলো ‘ম্যানেজ’ করতে হয়। দেশের বাস্তবতায় ঘাটে ঘাটে ‘ম্যানেজ’ করেই একটি রেস্তোঁরা চালানোর অনুমতি নিতে হয়।
রাজউকের দায়িত্ব কতটুকু, করছে কী
ঢাকায় অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যা কত—এ বিষয়ে রাজউকের কাছে সঠিক হিসাব নেই। তবে রাজউকের প্রক্রিয়াধীন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) ভৌত জরিপ থেকে একটি ধারণা পাওয়া যায়। ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় (ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সভার উপজেলা, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের আংশিক) প্রায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার স্থাপনা আছে।
জরিপের তথ্য বলছে, রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ৯৫ হাজার নতুন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। কিন্তু একই সময়ে রাজউক থেকে প্রতিবছর গড়ে ৪ হাজার ১৭৫টি স্থাপনার অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এই ১০ বছরে নির্মিত স্থাপনার ৯৫ দশমিক ৩৬ শতাংশই অবৈধ।
ড্যাপ ছাড়াও ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত পৃথক একটি জরিপ করেছিল রাজউক। ওই জরিপে নিয়ম না মেনে ভবন তৈরির ভয়াবহ একটি চিত্র উঠে আসে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও পল্লবী এলাকার ৯৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ ভবন; রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁও এলাকার প্রায় ৯৭ শতাংশ ভবন এবং ধানমন্ডি এলাকার প্রায় ৮৯ শতাংশ ভবন নির্মাণে অনুমোদিত নকশা মানা হয়নি।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী, অনুমোদন ও ব্যবহারসংক্রান্ত নিয়মের ব্যত্যয় হলে রাজউক অভিযান চালিয়ে জরিমানা, সংস্কারের নির্দেশনা দেওয়া, সতর্ক করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ হলে প্রয়োজনে ভবন ভেঙে ফেলতে পারে। তবে অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম না মানলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজউক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয় না।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মোহাম্মদ আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ব্যবহার সনদ) পুরোপুরি বাস্তবায়িত করা যায়নি। এটা নিশ্চিত করতে আন্তমন্ত্রণালয়ের একাধিক দল কাজ শুরু করেছে।
সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসও দায় নিতে চায় না
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন (২০০৩) অনুযায়ী, অবৈধ ভবন এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে অভিযান চালাতে পারে সিটি করপোরেশন। ভবনমালিককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করার ক্ষমতাও রয়েছে সিটি করপোরেশনের।
ট্রেড লাইসেন্সের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় নাগরিকদের সেবা সহজ করতে চুক্তিপত্র ও সাধারণ কয়েকটি বিষয় দেখে ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয়।
অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে ভবন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ভবনে স্থাপিত রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও ফায়ার লাইসেন্স নিতে হয়। এই লাইসেন্স দিয়ে থাকে ফায়ার সার্ভিস। অভিযোগ রয়েছে, এ ধরনের সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহারসংক্রান্ত শর্ত না মানলেও সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়। যেমন গ্রিন কোজি কটেজে ভবনে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস গণমাধ্যমে একটি চিঠি সরবরাহ করে। ওই চিঠিতে দেখা যায়, ভবনের অষ্টম তলায় একটি রেস্তোরাঁকে লাইসেন্স দেওয়ার পর শর্ত না মানায় সতর্ক করা হয়েছিল।
অথচ ওই ভবনে কোনো রেস্তোরাঁর অনুমোদন পাওয়ার কথা ছিল না, যেহেতু ভবনের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেই। নির্মাণের নকশা অনুযায়ী, ওই ভবনের আটতলা আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানেও রেস্তোঁরা ছিল। আবার সেই রেস্তোরাঁকে ফায়ার সনদ দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। সর্বশেষ গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ২২টি শর্তে ওই রেস্তোরাঁর ফায়ার লাইসেন্স নবায়ন করেছিলেন ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার হাউস পরিদর্শক অধীর চন্দ্র হাওলাদার।
ভবনের অকুপেন্সি সনদ না থাকার পরও কীভাবে ওই রেস্তোরাঁর ফায়ার সনদ নবায়ন হয়েছিল তা জানতে গতকাল রাতে অধীর চন্দ্র হাওলাদারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে প্রথম আলো; কিন্তু তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
এখন ‘সক্রিয়’ হতে চায় রাজউক
বেইলি রোডের ভবনে আগুন লাগার পর নিয়ম না মেনে তৈরি করা ভবনগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে রাজউক। ৪ মার্চ এ বিষয়ে রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটি সভা করেছে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, অনুমোদন নিয়ে করা ভবনগুলোর মধ্যে যারা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ব্যবহার সনদ) নেয়নি, সেগুলো চিহ্নিত করার জন্য রাজউকের আটটি অঞ্চলে আটটি দল আগামী রোববার থেকে কাজ শুরু করবে। পাশাপাশি অনুমোদনহীন ভবনগুলো চিহ্নিত করার কাজও চলবে। এই কাজে রাজউকের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ঢাকা জেলা প্রশাসনেরও সহায়তা নেওয়া হবে।
রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) মোহাম্মদ আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মের ব্যত্যয় করা ভবনগুলো চিহ্নিত করা গেলে সমাধানের উদ্যোগ নিতে সুবিধা হবে। আর ত্রুটিপূর্ণ ভবনগুলোকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হবে। ত্রুটি সংশোধনের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হবে। এর মধ্যে সংশোধন না করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজউকের একাধিক সূত্র বলছে, ২০১৯ সালে এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর একটি জরিপে উঠে এসেছিল, ১ হাজার ৮০০ ভবন নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে। ওই ভবনগুলোকে বিভিন্ন সময়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর কতটি ভবন ত্রুটিমুক্ত হয়েছে, সেই তথ্য রাজউকের কাছে নেই।
‘নজিরবিহীন অবহেলা’
ভবন নির্মাণ ও ভবন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো ‘নজিরবিহীন’ অবহেলা করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সহসভাপতি ও স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভবন নির্মাণের অনুমোদন, নির্মাণের পর ব্যবহার, অগ্নিনিরাপত্তার সনদ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি—এসব ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকিতে ঘাটতি আছে। ভবন অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করে ব্যবসার নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টিতে টাস্কফোর্স গঠন করে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এটি করতে না পারলে বেইলি রোডের মতো ঘটনা সামনে হয়তো আরও ঘটবে।