বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টার কথা বিদেশি গোয়েন্দারা জানত
লেখাটি ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আজ লেখটা পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার ১৫ আগস্ট হত্যা করা হলেও বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তাঁকে হত্যার চেষ্টা চলছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতেই এ ধরনের তৎপরতার খবর দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে পৌঁছে যায়। ওয়াশিংটনের নথিগুলোতে মার্কিনসহ বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মার্কিন নথি থেকে
১৯৭৫ সালে কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই চলে গোপন হত্যা ও হত্যাচেষ্টা। শুধু আগস্ট-সেপ্টেম্বর দুই মাসে বাংলাদেশ, লিবিয়া, চাদ, ইকুয়েডর, মিসর, সুদান, পতুর্গালসহ কয়েকটি দেশে অভ্যুত্থান হয়।
১৯৭৫ সালের ২১ মে বিকেলে মুজিবের ওপর এক দফা হামলা হয়। মুজিব অক্ষত থাকলেও এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই ব্যক্তি আহত হন। নতুন টিভি স্টেশন পরিদর্শন শেষে মুজিব যখন বাসায় ফিরছিলেন, তখনই তাঁর ওপর আক্রমণ চালানো হয়। রাষ্ট্রপতি মুজিবের নিরাপত্তায় নিয়োজিত উপপুলিশ সুপার মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত পলিটিক্যাল অ্যাসোসিয়েটকে এ কথা নিশ্চিত করেন। এ ছাড়া সাংবাদিকেরাও এ কথা দূতাবাসের তথ্য কর্মকর্তার কাছে বলেন। তবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তেই এ ঘটনার কথা জনগণকে জানতে দেওয়া হয়নি। তথ্য অধিদপ্তর খবরটি প্রকাশ না করার জন্য পত্রিকাগুলোর কাছে কড়া নির্দেশনা পাঠায়।
মুজিব সপরিবার নিহত হওয়ার অন্তত আট মাস আগে থেকেই দেশ-বিদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ ধরনের তৎপরতার ওপর নজর রাখছিল। মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনা হচ্ছে, এ ধরনের তথ্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ছিল।
১৬ মার্চ মুজিবের জন্মদিনের আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকার তিনটি স্থানে বোমা হামলা হয়। হামলাগুলো বিচ্ছিন্ন হলেও এগুলো মুজিবের ওপর হামলারই মহড়া হিসেবে মনে করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। একটি হামলায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বারে একজন নিহত ও চারজন আহত হন। নিউমার্কেটে হামলায় তিনজন আহত হন। তিনটি ঘটনায় ১২ জন আহত হন। সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর কিছু জুনিয়র কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও গোলাবারুদ নিয়ে নেমে আসেন ঢাকার রাস্তায়। তাঁরা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের বাসভবনে গিয়ে রাতের আঁধারে পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেন। রাষ্ট্রপতির বাসভবনে সেনাদের মোকাবিলার মতো কোনো পাহারারও ব্যবস্থা ছিল না।
অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের খুঁজে বের করা এবং তাঁদের বিচারের সম্মুখীন করা সম্ভব হলেও এ হত্যার পেছনে কোনো আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, তা জানা যায়নি। ঠান্ডা লড়াইয়ের (কোল্ড ওয়ার) কারণে তখন বিশ্বের ক্ষমতা সোভিয়েত আর মার্কিন শিবিরে বিভক্ত। তৃতীয় বিশ্বের একটি নতুন দেশের রাষ্ট্রপতি হত্যার ঘটনায় এই দুই পরাশক্তির দিকেই অভিযোগের তির নিক্ষিপ্ত হতে থাকে দেশে-বিদেশে। এই দুই পরাশক্তিকে অভিযুক্ত করে সংবাদ প্রকাশিত হয় বিশ্বের নানা দেশের পত্রপত্রিকায়।
ভারতীয় সংসদ সদস্যরা মুজিব হত্যার জন্য সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদীদের দায়ী করেন। কলকাতার বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক যুগান্তর এ ঘটনার জন্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টারকে অভিযুক্ত করে। তাদের যুক্তি, বোস্টার চিলিতে দায়িত্ব পালনের সময়ও সে দেশে অভ্যুত্থান হয়েছে। তবে মার্কিন সিনেট ভারতীয় পত্রিকার এই প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এ ছাড়া অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় আসা খন্দকার মোশতাক ও সেনাদের সঙ্গে মার্কিনিদের সম্পর্ক থাকায় এবং উপমহাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র পাকিস্তান তাদের চটজলদি স্বীকৃতি দেওয়ায় বিশ্লেষকেরা স্বাভাবিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।
অন্যদিকে ১৭ আগস্ট ইরানের ফারসি ভাষার পত্রিকা কাইহান মুজিব হত্যার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে দায়ী করে খবর প্রকাশ করে। তারা যুক্তি দেয়, সোভিয়েত আদর্শের বেশ কয়েকজন রাজনীতিককে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ায় তাঁরাই সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতা নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান।
প্রতিবেদকের কথা
কয়েক মাস আগে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের শাসনামলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী অ্যাডমিরাল স্ট্যানফিল্ড টার্নার ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিন সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের হত্যার জন্য সিআইএর গোপন অভিযান চালানোর কথা তিনি স্বীকার করেন। এ ধরনের অভিযানে কাউকে হত্যার পরিকল্পনা থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ ধরনের অভিযানের পর সিআইএকে মার্কিন কংগ্রেসের বিশেষ কমিটির কাছে বিস্তারিত জানাতে হয়।
প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক ও গবেষক লরেন্স লিফশুলৎজ ‘সত্যের সন্ধানে পঁচিশ বছর’ প্রবন্ধে মার্কিন দূতাবাসের একটি ঊর্ধ্বতন সূত্রের বরাত দিয়ে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতে ইচ্ছুক কিছু লোক দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দূতাবাসের সিআইএ স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি ও তাঁর এজেন্টরা এ যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। লিফশুলৎজ লিখেছেন, মার্কিন কংগ্রেস যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তলব দিয়ে জেরা করে তবেই একমাত্র এ ঘটনার সত্যাসত্য জানা যেতে পারে। তবে তিন দশক ধরে মুজিব হত্যার সত্য অনুসন্ধানী মার্কিন এই সাংবাদিক মনে করেন, অভ্যুত্থানে জড়িত রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে আগে থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তা সন্দেহাতীতভাবে পরিষ্কার।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদারককারী কর্মকর্তা সাবেক ডিআইজি (পুলিশের উপমহাপরিদর্শক) আবদুল হান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্ত করেননি। তিনি বলেন, সেটা করার মতো সময় ছিল না। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে কোনো দেশের কাছে যদি এ সম্পর্কে তথ্য থেকে থাকে এবং তারা তা প্রকাশ করে, তাহলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসতে পারে।