সাপের কামড়ে এখনো ওঝার শরণাপন্ন হন ৬১ শতাংশ মানুষ

প্রতীকী ছবি

দেশে রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে আতঙ্ক বাড়লেও সচেতনতা বাড়েনি। এখনো সাপের কামড়ে ৬১ শতাংশ মানুষ ওঝার কাছে যান; যাঁদের বেশির ভাগই ভুল চিকিৎসা দেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৯৫ শতাংশ গ্রাম, বিশেষত চরের অধিবাসী। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ (৩৫ থেকে ৪৪ বছর)।

এদিকে সঠিক চিকিৎসা না দিলেও এসব ‘গ্রাম্য চিকিৎসক’ আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন। এতে গড়ে একেকজন আক্রান্ত ব্যক্তির খরচ হয় ১ হাজার ৩৭২ টাকা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ কর্মসূচি ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ মোট ১১টি প্রতিষ্ঠানের এক যৌথ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ‘সাপের কামড়ে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি’ নিয়ে করা এ–জাতীয় জরিপের ফলাফল সম্প্রতি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে সাপের কামড়ে ক্ষয়ক্ষতি অর্ধেকে নামিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে জরিপটি করা হয়।

জরিপে দেখা গেছে, দেশে সাপের কামড়ে ৩৫ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও চিকিৎসকের কাছে যান। এ ক্ষেত্রে একেকজনের ১ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। গড়ে এ খরচ ২ হাজার ২৩২ টাকা। ৪ শতাংশ মানুষ এমন ব্যক্তির কাছে যান, এ বিষয়ে যাঁর কোনো ন্যূনতম ধারণা নেই। বছরে যে চার লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন, সামগ্রিকভাবে তাঁদের খরচ হয় ৯০ কোটি ২ লাখ ৩ হাজার ৫৪৪ টাকা।

দেশে যে চার লাখের বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন, তাঁদের অধিকাংশ এখনো গ্রামীণ ওঝার কাছে চিকিৎসার জন্য যান। এটা খুবই হতাশাজনক। চন্দ্রবোড়া নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর চেয়ে মানুষ কোথায় গিয়ে চিকিৎসা নেবেন, কী ধরনের চিকিৎসা নিলে দ্রুত ভালো হবেন, দেশের সাপ বেশি আছে এমন এলাকাগুলোর চিকিৎসাকেন্দ্রে অ্যান্টিভেনম আছে কি না, সে বিষয়ে জোর দিয়ে প্রচার চালানো উচিত।
এম এ ফয়েজ, বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান

এ বিষয়ে জরিপের অন্যতম দলনেতা ও সাপের বিষ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান এম এ ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে চার লাখের বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন, তাঁদের অধিকাংশ এখনো গ্রামীণ ওঝার কাছে চিকিৎসার জন্য যান। এটা খুবই হতাশাজনক। চন্দ্রবোড়া নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর চেয়ে মানুষ কোথায় গিয়ে চিকিৎসা নেবেন, কী ধরনের চিকিৎসা নিলে দ্রুত ভালো হবেন, দেশের সাপ বেশি আছে এমন এলাকাগুলোর চিকিৎসাকেন্দ্রে অ্যান্টিভেনম (বিষের প্রতিষেধক) আছে কি না, সে বিষয়ে জোর দিয়ে প্রচার চালানো উচিত।’

আরও পড়ুন

জরিপে আরও দেখা গেছে, সাপের কামড়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে ঘরের ভেতর বা আশপাশে থাকা গৃহিণীদের মধ্যে। মোট আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৩২ শতাংশ হচ্ছেন গৃহিণী। আর ২৬ শতাংশ গ্রামীণ কৃষক; যাঁরা কৃষিকাজ করার সময় সাপের কামড়ের শিকার হন। এরপর রয়েছে শিক্ষার্থী—১৯ শতাংশ। বাকিরা অন্য পেশার মানুষ। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে উপকূলীয় ও চর এলাকার অধিবাসীরা বর্ষা মৌসুমে বেশি সাপের কামড়ের শিকার হন।

জরিপে দেখা গেছে, দেশে সাপের কামড়ে ৩৫ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও চিকিৎসকের কাছে যান। এ ক্ষেত্রে একেকজনের ১ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। গড়ে এ খরচ ২ হাজার ২৩২ টাকা। ৪ শতাংশ মানুষ এমন ব্যক্তির কাছে যান, এ বিষয়ে যাঁর কোনো ন্যূনতম ধারণা নেই।

জরিপে মানুষ কোন ধরনের সাপের কামড়ের শিকার বেশি হন, সেটির একটি চিত্রও বেরিয়ে এসেছে। তাতে দেখা গেছে, এসব সাপের ২৪ শতাংশ বিষধর। অন্য সাপের বিষ নেই। বিষধর সাপের কামড়ে বছরে সাড়ে সাত হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এর পাশাপাশি যাঁরা বেঁচে যান, তাঁদের ১০ শতাংশের নানা শারীরিক সমস্যা রয়ে যায়।

আরও পড়ুন

ক্ষয়ক্ষতি

এদিকে সাপের কামড় খাওয়ার পর শারীরিক সমস্যার বাইরেও অনেকের মধ্যে আতঙ্কসহ নানা মানসিক জটিলতা দেখা দেয়। এর মধ্যে বিষণ্নতা ও মেজাজ খিটখিটে হওয়ার মতো সমস্যা হয় বেশি। ৩৯ শতাংশ সাপে কাটা মানুষ বিষণ্নতার শিকার হন এবং ৩৫ শতাংশের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কিন্তু এ জন্য তাঁরা কোনো চিকিৎসা নেন না।

জরিপে দেখা গেছে, সাপের কামড়ে গবাদিপশু ও খামারের হাঁস–মুরগিরও ক্ষতি হয়। আর্থিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গবাদিপশু খাত। বছরে প্রায় ১৯ হাজার গরু সাপের কামড়ের শিকার হয়। এর মধ্যে আড়াই হাজার গরু মারা যায়; যার আর্থিক মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি। আর হাঁস–মুরগি মারা যায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের।

সাপ বিশেষজ্ঞ আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাসেলস ভাইপার নিয়ে ভুল–শুদ্ধ যে আলোচনাই হোক, তা আমাদের ইতিবাচক সচেতনতা তৈরির কাজে ব্যবহার করতে হবে। সাপের কামড়ে যেন মানুষ আক্রান্ত না হন, সে জন্য সাপ দেখলেই তেড়ে না যাওয়া ও মারার চেষ্টা না করা উচিত। একই সঙ্গে কাউকে কামড় দিলে দ্রুত আশপাশের সরকারি–বেসরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া দরকার।’

আরও পড়ুন