ডলারের অভাবে গ্যাসের দাম বকেয়া, দিতে হচ্ছে জরিমানা
বিল না পেয়ে এলএনজি বিক্রি বন্ধের হুমকিও দিয়েছে বিদেশি কোম্পানি। উদ্বেগ জানিয়ে জ্বালানি বিভাগকে চিঠি পেট্রোবাংলার।
মার্কিন ডলারের অভাবে নিয়মিত গ্যাসের দাম পরিশোধ করতে পারছে না সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা। বিল বকেয়া রাখায় জরিমানা দিতে হচ্ছে তাদের।
পেট্রোবাংলা দেশীয় খনি থেকে উত্তোলিত গ্যাস বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে কেনে। আবার বিদেশ থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দামও তারাই দেয়। দুই ক্ষেত্রেই মূল্য পরিশোধ করতে হয় ডলারে। চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ে বিল দিতে না পারলে নির্ধারিত হারে জরিমানা দিতে হয়।
অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বিল না পেলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে বিদেশি কোম্পানি। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, এতে জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে দেশের সামগ্রিক বিরাজমান পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিবেচনায় বিষয়টি অতীব জরুরি।
যেমন ১১ জুলাই জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়ে পেট্রোবাংলা জানায়, তিন কার্যদিবসের মধ্যে বিল না পেলে গানভর সিঙ্গাপুর পিটিই লিমিটেড ভবিষ্যতে এলএনজি সরবরাহ করবে না বলে জানিয়েছে। ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি (এসবিএলসি) থেকে তারা টাকা আদায় করবে। একইভাবে টাকা আদায় করার হুমকি দিয়েছে টোটাল এনার্জিস।
এই দুই কোম্পানির কাছে বকেয়া পড়েছিল ১১ কোটি ডলার। এরপর কিছু বিল পরিশোধ করে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করা হয়। এদিকে ১৩ জুলাই বকেয়া বিল চেয়ে পেট্রোবাংলাকে চিঠি দেয় দেশীয় খনি থেকে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের সমস্যা ছিল। এটি নিয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের ব্যবস্থা করেছে। তিনি বলেন, শেভরনের বিল পরিশোধ শুরু হয়েছে। অন্যদের বিলও দেওয়া হচ্ছে। ডলার নিয়ে আর সমস্যা হবে না।
চড়া দামে এলএনজি কেনার কথা বলে গত জানুয়ারিতে গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। টানা সাত মাস বন্ধ থাকার পর গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় খোলাবাজারের এলএনজি আমদানি। তবে তাতে ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে।
আগস্টের মধ্যে বিল চায় শেভরন
দেশীয় খনি থেকে উত্তোলন ও আমদানি মিলিয়ে এখন দিনে প্রায় ৩০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে ২২০ কোটি ঘনফুটের মতো দেশীয় গ্যাস। বাকিটা আমদানি করা হয়।
দেশের খনির গ্যাসের ৬০ শতাংশই সরবরাহ করে শেভরন (বিবিয়ানা ও জালালাবাদ)। প্রতি মাসে তাদের বিলের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ডলার। পেট্রোবাংলা ও শেভরন সূত্র বলছে, চুক্তি অনুসারে গ্যাস বিল জমা দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তা পরিশোধ করতে হয়। বিল দিতে দেরি হলে নির্ধারিত হারে জরিমানা হিসেবে দিতে হয়। চুক্তি অনুযায়ী, পাঁচ মাস বিল বকেয়া থাকলে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ করতে পারে শেভরন।
শেভরন চেয়েছিল পরিচালন ব্যয় মেটাতে পেট্রোবাংলা যাতে মাসে অন্তত আড়াই কোটি ডলার করে বিল দেয়। কিন্তু ডলার না পাওয়ায় পেট্রোবাংলা পুরো অর্থ দিতে পারছে না। এক কোটি বা দেড় কোটি ডলার করে মাসে পরিশোধ করা হচ্ছে। এতে প্রতি মাসেই বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে।
গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পেট্রোবাংলা এখন মুনাফা করছে। কিন্তু টাকা দিয়ে তো ডলারের সংকট মেটানো যাবে না। বড় ধরনের আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। ডলারের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বকেয়ার চাপ বাড়ছে। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ১৩ জুলাই দেওয়া চিঠিতে আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য অনুরোধ করেছে শেভরন। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে শেভরন বাংলাদেশের মুখপাত্র শেখ জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানির নীতি অনুসারে বাণিজ্যিক কোনো বিষয়ে তাঁরা মন্তব্য করেন না।
শেভরনের চিঠি পেয়ে পেট্রোবাংলা ১৬ জুলাই জ্বালানি বিভাগকে একটি চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গ্যাস বিল ও জরিমানাসহ গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত শেভরনের বকেয়া জমেছে প্রায় ২৮ কোটি ডলার। এ অবস্থা চলতে থাকলে গ্যাস সরবরাহে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
চিঠিতে শেভরনের বিল পরিশোধের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘বর্তমানে দেশের সামগ্রিক বিরাজমান পরিস্থিতি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সংবেদনশীল বিবেচনায় বিষয়টি অতীব জরুরি।’
পেট্রোবাংলা গত জানুয়ারি থেকে জ্বালানি বিভাগকে কয়েক দফা চিঠি দিয়ে পরিস্থিতি জানিয়েছে। সংকট উত্তরণে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সহায়তা চেয়ে একাধিক দফা চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। অবশ্য সমস্যার পুরো সমাধান হয়নি।
জরিমানা কত
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, শেভরনের বকেয়ার ওপরে যুক্ত হচ্ছে জরিমানা, যার হার লন্ডন আন্তব্যাংক সুদের হারের (লাইবর) চেয়ে এক শতাংশ বেশি। সব মিলিয়ে তা সাড়ে চার শতাংশে দাঁড়ায়। গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের ৬ মার্চ পর্যন্ত ১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার জরিমানা দাবি করেছে শেভরন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫০ কোটি টাকার বেশি।
শেভরনের বাইরে তাল্লো নামের আরেকটি বিদেশি কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করে। তাদের বিল অবশ্য তেমন বেশি নয়।
ওমান ও কাতার থেকে নিয়মিত এলএনজি আমদানি করে সরকার। খোলাবাজার থেকে কিনে এলএনজি সরবরাহ করে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি। এলএনজি রূপান্তরের জন্য দুটি টার্মিনালকেও প্রতি মাসে ডলারে বিল পরিশোধ করতে হয়।
পেট্রোবাংলার দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেরিতে বিল দিলেও সাধারণত জরিমানা নেয় না ওমান। তবে কাতার একটুও ছাড় দেয় না। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট পর দিলেও তাদের স্বয়ংক্রিয় বিল ব্যবস্থায় জরিমানা হিসাব করা হয়। এলএনজি টার্মিনালকেও জরিমানা দিতে হয়। খোলাবাজার থেকে এলএনজি সরবরাহকারী কোম্পানিরও আছে জরিমানার বিধান।
ওই দুই কর্মকর্তা আরও বলেন, আগে থেকে জানিয়ে একটু দেরি করলে শেভরন জরিমানা নেয় না। তবে এক বছর ধরে বিল পরিশোধে যে দেরি হয়েছে, তার জরিমানা দিতেই হবে। এর আগে ১৭টি কার্গোর এলএনজি বিল দেরিতে শোধ করায় কাতার গ্যাসকে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার জরিমানা পরিশোধ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৮০ কোটি টাকার সমান।
সময়মতো বিল দিতে না পারলে কী ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, তা উঠে এসেছে জ্বালানি বিভাগকে দেওয়ার পেট্রোবাংলার চিঠিতে। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংকের নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি থেকে কোনো কোম্পানি যদি বিল আদায় করে, তাহলে তা দেশে–বিদেশে জানাজানি হওয়ার আশঙ্কা আছে। এতে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানির দরপত্রে অংশ নিতে বিদেশি কোম্পানির আগ্রহ কমবে। দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। পেট্রোবাংলার পক্ষে নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হবে না দেশের কোনো ব্যাংক।
‘ঝুঁকিতে পড়বে সরবরাহ’
২০২১ সালের আগস্টে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এখন তা ৩ হাজার কোটি ডলারের আশপাশে। এর আগে ডলারের সংকটে পড়ে গত বছর জুলাইয়ে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। এতে দেশে গ্যাস সরবরাহ কমে যায়। শুরু হয় পরিকল্পিত লোডশেডিং। শিল্পকারখানা ভুগতে থাকে।
চড়া দামে এলএনজি কেনার কথা বলে গত জানুয়ারিতে গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। টানা সাত মাস বন্ধ থাকার পর গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় খোলাবাজারের এলএনজি আমদানি। তবে তাতে ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে পেট্রোবাংলা এখন মুনাফা করছে। কিন্তু টাকা দিয়ে তো ডলারের সংকট মেটানো যাবে না। বড় ধরনের আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছে। ডলারের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বকেয়ার চাপ বাড়ছে। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।