ডেঙ্গুতে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি, মৃত্যুও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাঁদের প্রসব জটিলতা দেখা দেয় অন্য নারীদের চেয়ে বেশি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৬ শতাংশ নারী মৃত সন্তানের জন্ম দেন।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্যসমস্যা, প্রসব জটিলতা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণাটি যৌথভাবে করেছে অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলনকক্ষে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা ও উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে গবেষক ও নারী স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য নিয়ে দেশে এ ধরনের গবেষণা এটাই প্রথম। গবেষণায় অর্থিক সহায়তা দিয়েছে ইউএনএফপিএ।
গত বছর রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া ও মারা যাওয়ার পর দেশের মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ে একধরনের ভীতি তৈরি হয়েছে। মে মাস শুরু হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে যে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এই গবেষণার ফলাফল নীতিনির্ধারকদের কাজে লাগবে বলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত একাধিক ব্যক্তি মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের মশার সঙ্গেই বসবাস করতে হবে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুটা কীভাবে কমানো যায়, আমাদের সে চেষ্টা করতে হবে।’
গবেষণার উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি
গর্ভবতী নারী ও নবজাতকের ওপর ডেঙ্গুর কী প্রভাব পড়ে, তার কোনো তথ্য–উপাত্ত দেশে ছিল না। সেই তথ্য–উপাত্ত তৈরি করা এই গবেষণার একটি উদ্দেশ্য ছিল। এ ছাড়া গর্ভবতী নারীদের জন্য ঝুঁকি চিহ্নিত করাও একটি উদ্দেশ্য ছিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ২৪৪ জন গর্ভবতী নারীর ওপর এই গবেষণা হয়েছে। নারীদের ১২২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিলেন। বাকি ১২২ জনের ডেঙ্গু ছিল না। এসব নারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
১৩ জনের একটি দল গবেষণার মূল কাজটি করেছে। গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর ও ওজিএসবির সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক সামিনা চৌধুরী এবং কো–প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর আইসিডিডিআরবির সাবেক বিজ্ঞানী এ টি এম ইকবাল আনোয়ার।
গবেষণা ফলাফল
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব নারী মশা বংশবিস্তার করে এমন জায়গার কাছাকাছি বসবাস করেন, তাঁদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যেসব নারীর বাড়ির ছাদে বাগান আছে, তাঁদের ঝুঁকিও তুলনামূলক বেশি। অন্যদিকে যেসব নারীর শিক্ষা কম, তাঁদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি।
হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নন—দুই ধরনের নারীদের শারীরিক লক্ষণে বেশ পার্থক্য ধরা পড়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের ৯৩ শতাংশের জ্বর ছিল, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নন এমন ৩ শতাংশের জ্বর ছিল। মাথাব্যথা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, পেশিতে ব্যথা সবই অনেক বেশি দেখা গেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের।
দুই দলের নারীদের মধ্যেই গর্ভধারণে জটিলতা ছিল। তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে এই জটিলতা ছিল ১৬ শতাংশের এবং অন্যরা ছিল ১৩ শতাংশের। খিঁচুনি, গর্ভপাত বেশি দেখা গেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে। প্রসবপরবর্তী রক্তক্ষরণও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে প্রায় তিন গুণ বেশি।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের ৩১ জনের প্রসবে জটিলতা দেখা দেয়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নন এমন ১২ জন নারীর প্রসবে জটিলতা ছিল। গবেষকেরা বলেন, প্রসব জটিলতা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে ২ দশমিক ৭৮ গুণ বেশি। অন্যদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৯ জন নারী মৃত সন্তান জন্ম দেন, ডেঙ্গু ছিল না এমন ৯ জন নারী মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছেন।
গবেষণায় তথ্য নেওয়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নন নারীর সংখ্যা ছিল সমান। কিন্তু এদের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নন এমন নারী মারা গেছেন একজন, কিন্তু অন্য দলের নারী মারা গেছেন পাঁচজন।
গবেষকেরা বলেন, মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে গর্ভবতী নারীদের বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এ ছাড়া আরও বড় আকারের গবেষণার জন্য এখনই উদ্যোগ নেওয়ার কথা তাঁরা বলেছেন।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট স্ত্রী রোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওশন আরা বেগম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আসাদুল কবীর। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচির উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক মুস্তফা আহমদ।