একাত্তরের দিনপঞ্জি—১৫
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়
১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ডিসেম্বর মাসে দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বিজয়ের এই মাসে আমরা হাজির করছি তারিখ ধরে ধরে সেই দিনগুলোর ঘটনাধারা। ঈষৎ সংক্ষেপ করে লেখাটি নেওয়া হয়েছে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিতব্য বই একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি থেকে।
দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পায় বহু প্রত্যাশিত বিজয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের আপামর জনতা পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম দেয় বাংলাদেশ নামে নতুন এক রাষ্ট্রের। হাজার হাজার মানুষের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ঢাকায় আবেগপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে অস্ত্র ও সেনা সমর্পণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন (পরবর্তী সময়ে এয়ার ভাইস মার্শাল) এ কে খন্দকার। বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আরও ছিলেন এস ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ, ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর এ টি এম হায়দার, কাদের সিদ্দিকীসহ অনেকে।
আগেই নিয়াজি যুদ্ধবিরতি ও অস্ত্রসংবরণের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে জানানোর জন্য ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসে নিয়োজিত সামরিক অ্যাটাশেকে অনুরোধ করেন। দিল্লির যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারকে তা জানানো হয়। বেলা ১১টার দিকে যৌথ বাহিনীর দুই প্রতিনিধি নিয়াজির হেডকোয়ার্টার থেকে ফিরে আসেন। নিয়াজির প্রতিনিধি হিসেবে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব নিয়ে আসেন মেজর জেনারেল জামশেদ। দুপুর ১২টার দিকে তাঁর সঙ্গে মেজর জেনারেল নাগরা পৌঁছান নিয়াজির অফিসে। এরপর শুরু হয় আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নিয়ে কথাবার্তা। বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব। ততক্ষণে যৌথ বাহিনী মিরপুর সেতু পেরিয়ে ঢাকায় ঢুকতে শুরু করেছে।
বিকেল পৌনে চারটায় নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আসেন। নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে যান ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। দলিলে স্বাক্ষর করে নিয়াজি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে। ঘড়িতে তখন বিকেল ৪টা ১ মিনিট।
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা করেন, তাঁদের সরকার পরের সপ্তাহে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করবে। বাংলাদেশ সরকারের একজন মুখপাত্র জানান, ১৭ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন বেসামরিক প্রশাসন চালু করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
ঢাকা স্বাধীন দেশের রাজধানী
ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার সব আসন পূর্ণ। সদস্য, সাংবাদিক ও দর্শক। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে বলেন, ‘আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমার ধারণা, এই সভা কিছুকাল যাবৎ এই ঘোষণার প্রতীক্ষায় ছিল। [বাংলাদেশে] পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।’
ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানান এবং মুক্তিবাহিনীর বীরত্বে জয়ধ্বনি দেন।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১