ফসলি জমিতে পুরোনো পোকার উপদ্রব
বাংলাদেশের ফসলের জমিতে পুরোনো পোকামাকড় ফিরে আসছে। এত দিন সংখ্যায় কম থাকায় ফসলের জন্য এগুলো তেমন ক্ষতিকর ছিল না। কিন্তু ১০ প্রজাতির পোকা হঠাৎ বেড়ে গেছে। এসব পোকামাকড় আমন ও আউশ ধানের জন্য বিপদ বাড়াচ্ছে। গত চার বছরে দেশে ৭০টি ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’ নামের নতুন প্রজাতির পোকার আক্রমণ দেখা যাচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহ, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, পঙ্গপাল বা ডেজার্ট লোকাস্টের মতো কীটপতঙ্গের আক্রমণে ফসল উৎপাদনে বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং পোকামাকড় নিয়ে গবেষণা করে এমন একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। তারা বলছে, বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অতিবৃষ্টির কারণে এসব পোকামাকড়ের প্রজনন ও উপদ্রব বেড়ে গেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাও (এফএও) বাংলাদেশে ফল আর্মিওয়ার্মসহ নতুন ধরনের পোকার আক্রমণের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছে। এসব পোকামাকড় ভবিষ্যতে আরও বিপদ বাড়াতে পারে বলে এসব সংস্থার আশঙ্কা।
মূলত গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পুরোনো পোকামাকড় ফিরে আসছে। আমরা এসব পোকা দমনে প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি। মাঠপর্যায়ে এসব পরামর্শ ছড়িয়ে দিলে পোকা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা-পিএসও মো. নাজমুল বারী
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটপতঙ্গ বিভাগের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ধানসহ দানাদার খাদ্যে ১০ ধরনের পোকার আক্রমণ বেড়েছে। মূলত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এসব পোকা বাড়ছে। এরা পরিপক্ব হচ্ছে, এমন ধান খেয়ে ফেলছে। এ ছাড়া ধানের পাতা, গোড়া ও শিষ খাওয়ায় উৎপাদন কমছে। এসব পোকা দমনে রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারে সমস্যা আরও বাড়ছে। এতে পরিবেশ, প্রকৃতি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি হচ্ছে।
ব্রির গবেষণায় বলা হয়, যে ১০ ধরনের পোকার আক্রমণ বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে বাদামি ঘাসফড়িং ও মাজরা পোকার আক্রমণ বেশি বেড়েছে। এ ছাড়া হলুদ মাজরা পোকা, ঘাসফড়িং ও বাদামি ঘাসফড়িং পোকা পাকা ধান খেয়ে ফেলছে। রয়েছে পামরি পোকা, গল মাছি, ধানের গান্ধী পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতা মোড়ানো পোকা, শুঁয়াপোকা, ছাতরা পোকা, চুঙ্গি পোকা, উরচুঙ্গা, ধানের থ্রিপস পোকা।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটপতঙ্গ বিভাগের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ধানসহ দানাদার খাদ্যে ১০ ধরনের পোকার আক্রমণ বেড়েছে। মূলত তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এসব পোকা বাড়ছে।
পঙ্গপাল ও ফল আর্মিওয়ার্মের বিপদ
পোকার নাম ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’। ২০২২ সালে দেশে ভুট্টাখেতে প্রথম নতুন ধরনের একটি পোকা দেখা যায়। উত্তর আমেরিকার স্থানীয় জাতের ওই পোকা ২০১৬ সালে আফ্রিকায় দেখা দেয়। এরপর ২০১৮ সালে এশিয়ায়। পরের বছর বাংলাদেশে দেখা যায়। কৃষকেরা ওই পোকার বিপদ বোঝার আগেই সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে।
কৃষি মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করে এই পোকা নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি নেয়। দ্রুত পদক্ষেপ ও সেচের পানির তোড়ে ওই পোকার ডিম নষ্ট হয়ে যায়। বিপদ থেকে রক্ষা পান কৃষকেরা।
২০২১ সালে এফএও থেকে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ফল আর্মিওয়ার্ম পোকার আক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। ‘সায়েন্টিফিক রিভিউ অব দ্য ইমপ্যাক্ট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অন প্ল্যান্ট পেস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি ধরে রাষ্ট্রগুলো কৃষিব্যবস্থায় নতুন পরিকল্পনা তৈরি করে।
এরপর ২০২০ সালের মে মাসে কক্সবাজারের টেকনাফে পঙ্গপালের মতো দেখতে একঝাঁক পোকা আক্রমণ করলে, সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়।
এ ব্যাপারে ব্রির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা-পিএসও মো. নাজমুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূলত গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় পুরোনো পোকামাকড় ফিরে আসছে। আমরা এসব পোকা দমনে প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছি। মাঠপর্যায়ে এসব পরামর্শ ছড়িয়ে দিলে পোকা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।’