জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা
শুধু সন্দেহ ও অনুমান দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি হতে পারে না: রাষ্ট্রপক্ষ
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপিল শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, শুধু সন্দেহ ও অনুমান কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি হতে পারে না। আর দুদকের আইনজীবী বলেছেন, ঘটনাদৃষ্টে এই মামলায় অপরাধী মনোভাব দেখা যায় না।
তৃতীয় দিনের শুনানিতে আজ বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবী এ কথাগুলো বলেন। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ এ শুনানি গ্রহণ করেন।
আজ শুনানির শেষ পর্যায়ে ওই মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কাজী সালিমুল হক কামাল আপিল করেছেন এবং এই আপিলের সারসংক্ষেপ জমা না দেওয়ার বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য সময় চাওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আপিল (খালেদা জিয়া ও শরফুদ্দিন আহমেদ) আংশিক শ্রুত হিসেবে রেখেছেন। এসব আপিলের সঙ্গে সালিমুল হকের আপিলটি যুক্ত করে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ করে সাজা ১০ বছর বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ খালেদা জিয়া পৃথক দুটি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। গত বছরের ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল মঞ্জুর এবং সাজার রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করে আদেশ দেন। এ ছাড়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে শরফুদ্দিন আহমেদ আপিল করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার দুটি আপিল ও শরফুদ্দিনের একটি আপিল একসঙ্গে শুনানির জন্য ওঠে। গত মঙ্গলবার, গতকাল বুধবার ও আজ বৃহস্পতিবার আপিলের ওপর শুনানি হয়।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, এম বদরুদ্দোজা ও আইনজীবী কায়সার কামাল শুনানিতে অংশ নেন। খালেদা জিয়া ও শরফুদ্দিনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস শুনানি করেন। খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী রাগীব রউফ চৌধুরী, জাকির হোসেন ভূইয়া, মাকসুদ উল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও অনীক আর হক। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আসিফ হাসান।
কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি
বিচারিক আদালতে খালেদা জিয়ার ৩৪২ ধারার (আত্মপক্ষ সমর্থন) প্রসঙ্গ তুলে ধরে আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন, আদালতের প্রতি অনাস্থা দেওয়া সত্ত্বেও জবরদস্তিমূলক আচরণের মাধ্যমে ৩৪২ ধারায় বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হয়। কী অবস্থার মধ্য দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। ৩৪২ ধারার বক্তব্য কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। এটি সাধারণ ফৌজদারি মামলা নয়, এটি উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক মামলা।
পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালের ২৬ অক্টোবর খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্য আদালতে পড়ে শোনানোর সময় আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন আইনজীবী কায়সার কামাল। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সিনিয়র সিটিজেন খালেদা জিয়া। অথচ কোনো কিছু আমলে নেওয়া তো দূরের কথা, কথা বলারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। মধ্যযুগীয় আচরণ করা হয়েছে। ১০–১২ জনের বেশি আইনজীবীকে তখন আদালতে প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। এর আগে তল্লাশি তো ছিলই। এ ছাড়া দুদকের তৎকালীন প্রসিকিউটর কদর্যময় ভাষা ব্যবহার করতেন।
শুধু অনুমান ও ধারণা দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি হতে পারে না
এর আগে গতকাল বুধবার সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদ তুলে ধরে শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মামলার বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আজ শুনানিতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় ক্রটি নেই। তবে শুধু সন্দেহ ও অনুমান কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি হতে পারে না। ধারণার ভিত্তিতে খালেদা জিয়াকে মামলায় মুখ্য অপরাধী করা হয়। শুধু ধারণা কি যৌক্তিক হতে পারে? বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট রায়ে ভুল করেছেন। শুধু অনুমান ও ধারণা দোষী সাব্যস্ত করার ভিত্তি হতে পারে না—এই মামলাটি সে ধরনের।
মামলার এজাহার ও তথ্যাদি তুলে ধরে দুদকের আইনজীবী আসিফ হাসান শুনানিতে বলেন, ঘটনাদৃষ্টে এই মামলায় অপরাধী মনোভাব দেখা যায় না। ট্রাস্টের জন্য সম্পত্তি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে ব্যর্থ হওয়ায় অর্থ এককালীন আমানত হিসেবে জমা রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে অর্থ অপব্যয় হয়নি।
শুনানির শেষ পর্যায়ে আদালতের প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা জানান, ওই মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কাজী সালিমুল হক কামাল আপিল করেছেন। আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া হয়নি। তাঁর পক্ষে উপস্থিত আইনজীবী এম হারুনুর রশীদ খান জানান, আপিলের সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করা হয়েছে। সারসংক্ষেপ দাখিলের জন্য সময়ের আরজি জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ১৪ জানুয়ারি শুনানির পরবর্তী দিন রাখেন।
মামলার পূর্বাপর
এতিমদের সহায়তার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই ওই মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত-৫ রায় দেন।
রায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও মমিনুর রহমানকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন খালেদা জিয়া। কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে কাজী সালিমুল হক ও শরফুদ্দিন আহমেদ পৃথক আপিল করেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধি চেয়ে দুদকের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল দেন। তিনটি আপিল ও রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট একসঙ্গে রায় দেন। রায়ে খালেদা জিয়ার আপিল খারিজ হয়। দুদকের রিভিশন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া রুল যথাযথ ঘোষণা করে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ ও কাজী সালিমুল হকের আপিল খারিজ করেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে গত বছর আপিল করেন শরফুদ্দিন আহমেদ, যেটি খালেদা জিয়ার আপিলের সঙ্গে শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ওঠে ও শুনানি হয়।