‘তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি?’
আমি বর্তমানে বঙ্গভবনে মশালচি হিসেবে চাকরি করছি। ১৯৭২ সাল হতে এই চাকরি করছি। ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৬৭৭ নং বাড়িতে কাজ শুরু করি। ১৯৭২ সালে চাকরি হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কাজ করি। চাকরি হওয়ার পূর্বাপর আমি এবং রহমান (রমা) বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দোতলায় থাকিতাম। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আড়াইতলা, অর্থাৎ তিনতলায় মাত্র ২টা রুম, সেই জন্য আমরা আড়াইতলা বলে থাকি, দোতলায় ৬টা রুম।
নিচতলায় ৭টা রুম। বাড়ির উত্তর দিকে রান্নাঘর, গোয়ালঘর ও গ্যারেজ আছে। বাড়ির চারিদিকে অনুমান ৫ হাত উঁচু ওয়াল আছে। ওয়ালের ওপর তারকাঁটা লাগানো আছে। বাড়ির দক্ষিণ দিকে মাত্র একটা গেট আছে।
গেট দিয়ে ভিতরে গেলে সামনে একটা করিডর পড়ে। করিডরের দুই পাশে রুম আছে। বাড়ির মাঝখানে একটা এবং বাড়ির পূর্ব দিক দিয়ে একটা মোট দুইটা সিঁড়ি আছে (আপত্তিসহকারে তা রেকর্ড হলো) মাঝের সিঁড়ি দিয়ে পশ্চিম দিকে এবং পূর্ব দিকের সিঁড়ি দিয়ে পূর্ব দিকে মুখ করে ওপরে উঠিতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারে তিনি, তাঁর স্ত্রী, তিন পুত্র, দুই কন্যা এবং দুই পুত্রবধূসহ মোট ৯ সদস্য ছিল। ঘটনার দিন ৭ জনকে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল ৫টার দিকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সংঘটিত হয়। ঘটনার রাত্রে আমি এবং রমা দোতলায় বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের সামনে ঘুমিয়েছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু খুব জোরে দরজা খুললে আমার এবং রমার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে দেখি বঙ্গবন্ধু গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি পরা অবস্থায় নিচের দিকে যাচ্ছেন।
ওই রাত্রে তিনতলায় কামাল ভাই ও তাঁর স্ত্রী, দোতলায় জামাল ভাই ও তাঁর স্ত্রী এবং পুত্র রাসেল এক রুমে ছিল। রেহানার রুমে নাসের কাকা ছিল। তখন হাসিনা এবং রেহানা বিদেশে ছিল।
নিচতলায় ডিএসপি নূরুল ইসলাম, পিএ/রিসিপশনিস্ট মহিতুল ইসলাম, টেলিফোন মিস্ত্রি মতিন ও অন্যান্য লোক ছিল।
বঙ্গবন্ধু নিচে যাবার পর বেগম মুজিব আমাকে তাঁর চশমা এবং পাঞ্জাবি দিলে আমি নিচে বঙ্গবন্ধুকে তা দিই। তিনি চশমা-পাঞ্জাবি পরিয়া নেন। আমি বঙ্গবন্ধুর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন তিনি বলছিলেন, ‘আমার এবং আমার বোনের বাসা আক্রমণ করেছে, রাজারবাগ ফোন কর।’ এমন সময় বাইর হতে একঝাঁক গুলি ভেতরে আসে। তখন তিনি এবং আমি বসে পড়লাম। তিনি ক্যান্টনমেন্ট, রাজারবাগসহ কোথাও টেলিফোন লাইন না পেয়ে দোতলার দিকে চলে গেলেন। আমি পিছনে পিছনে চলে গেলাম।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার সময় কামাল ভাইকে তিনতলা হতে নিচে নামতে দেখি। এদিকে বঙ্গবন্ধু নিজের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। তারপর দক্ষিণ দিকে গুলির শব্দ শুনি। আমি দৌড়ে জামাল ভাইয়ের রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে দেখি কয়েকজন কালো পোশাক পরিহিত লোক গুলি করতে করতে বাড়ির ভিতরে ঢুকেছে। গুলি লাগিবার ভয়ে আমি জামাল ভাইয়ের বাথরুমে ঢুকে বসে থাকি।
তখন জোরে জোরে বলছে, ‘যে যেখানে আছ সারেন্ডার করো।’ আমি সিঁড়ির দিকে উঁকি দিয়ে দেখি দুজন কালো পোশাকধারী সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আমি তখন আবার বাথরুমে ঢুকে পড়ি। তারপর কালো পোশাকধারী দুজন লোক আমার কাছাকাছি এলে আমার কিছু সাহস হয়। এই কারণে যে আর্মি দুষ্কৃতকারীদের খবর পেয়ে এসেছে। এই মনে করে আমি উঠতে গেলে তারা আমাকে গুলি করে। গুলি আমার হাতে-পেটে লাগে (এই পর্যায়ে সাক্ষী তাঁর হাতের ও পেটের জখম দেখায়), তখন আমি সামনের দিকে পড়ে যাই।
পরে আমি সিঁড়ির পাশে হেলান দিয়ে বসে থাকি। বসে থাকা অবস্থায় দেখি যে, ৪-৫ জন আর্মির লোক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর রুম থেকে ধরে সিঁড়ির দিকে আনছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বলল, ‘এই ছেলেটা ছোটবেলা হতে আমাদের এখানে থাকে। একে কে গুলি করল?’ এরপর তিনি বলিলেন, ‘তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবি? কী করছি—বেয়াদপি করছ কেন?’ এর কিছুক্ষণ পরে সিঁড়ির দিকে গুলির শব্দ ও চিৎকারের শব্দ শুনতে পাই।
একটু পরে দেখি আম্মাকে (বেগম মুজিব), রাসেলকে, নাসের কাকাকে ও রমাকে আর্মিরা নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ির কাছে গিয়েই আম্মা চিৎকার করে উঠে, ‘আমি ওই দিকে যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’ তারপর নাসের, রাসেল ও রমাকে নিচের দিকে এবং আম্মাকে (বেগম মুজিব) বেডরুমের দিকে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই বেডরুম থেকে গুলির শব্দ এবং চিৎকারের শব্দ শুনতে পাই।
কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হয়ে গেল। আমি বসে থাকা অবস্থায় একজন আর্মি এসে আমাকে বলল, ‘তোমার গুলি লাগছে?’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ, লাগছে।’ তারপর আর্মিদের বিভিন্ন রুম খোঁজাখুঁজি করতে দেখি। একটু পরেই আর্মির লোক আমাকে বলল, ‘তুমি হেঁটে নিচে যেতে পারবা?’
আমি বললাম, ‘পারব।’ তখন আমাকে হাত ধরে টেনে উঠিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামাতেই দেখি সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে আছে। ওই লাশের ওপর দিয়ে আমাকে নিচে নিয়ে যায়। নিচে বারান্দা দিয়ে গেটের দিকে নিবার সময় কামাল ভাইয়ের লাশ পড়ে থাকতে দেখি। তারপর আমাকে গেটের ভিতরে লাইনে নিয়ে বসায়। সেখানেও একজন সিকিউরিটির লোকের লাশ পড়ে থাকতে দেখি।
লাইনে ডিএসপি নূরুল ইসলাম, মহিতুল ইসলাম, রমা, রাসেল ভাইকে দেখলাম। রাসেল মহিতুল ইসলামের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আমাকে লক্ষ্য করে একজন আর্মির লোক অন্য একজন আর্মিকে বলল, ‘এর গায়ে গুলি লেগেছে। একে হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ একটু পরেই একটা ট্যাংক এবং একটা জিপ এল।
ট্যাংক হতে কয়েকজন অফিসার নেমে অন্য আর্মিদের সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলায় কী যেন কথাবার্তা বলল। তখন রাসেলকে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই দোতলা হতে গুলির শব্দ ও চিৎকার শুনলাম।
তারপর ট্যাংকের পিছনে আসা জিপে করে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে যাবার পর শেখ সেলিম ও শেখ মারুফের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তারা আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির খবর জিজ্ঞাসা করলে আমি জানাই যে, সবাইকে মেরে ফেলেছে।
আমি পড়ালেখা জানি না। তদন্তকারী অফিসারের কাছে আমি জবানবন্দি দিয়েছি।
স্বাক্ষর—
মো. সেলিম (আবদুল)