দেশের ঐতিহ্য, আবহাওয়া, জলবায়ু ও মানুষকে নিজের স্থাপনায় প্রাধান্য দিয়েছেন বাংলাদেশের আধুনিক স্থপতির পথিকৃৎ মাজহারুল ইসলাম। কিন্তু এখনকার স্থাপনা ও নগর উন্নয়নে সেসবের প্রতিফলন নেই বললেই চলে। কাচঘেরা ভবন, বদ্ধ পরিবেশের ভবনই বেশি গড়ে উঠছে। গণতান্ত্রিক স্থাপত্য, যেখানে মানুষের সহজ প্রবেশাধিকার থাকবে, সেটাও আর দেখা যায় না। নগর উন্নয়ন এবং স্থাপনাগুলোতে মানুষ ও প্রকৃতির সংযোগ ঘটাতে হবে।
বুধবার ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘স্থপতি মাজহারুল ইসলামের জন্মশতবার্ষিকী: বাংলাদেশ উন্নয়ন ও চেতনায় শিল্প সংস্কৃতি’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে।
গোলটেবিলটির আয়োজক ছিল মাজহারুল ইসলাম ফাউন্ডেশন ও প্রথম আলো।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, শিল্প এবং স্থাপত্য পড়ানো যায় কিন্তু শেখানো যায় না। ষাটের দশকে বাংলাদেশ, বাঙালি, সংস্কৃতি, জলবায়ু—এই চিন্তায় যে দর্শন তৈরি হয়েছিল, তা এখন হয় না। এখন তো সবাই আরও আধুনিক হয়েছে, উন্নত হয়েছে, কিন্তু তেমন উন্নত কাজ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, রাজনীতিবিদেরা একটা ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই ধারা তৈরি হয় পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে। আর সেই পরিবেশকে লক্ষ করেই রাজনীতিবিদ তার রাজনীতিটা করেন।
বর্তমান সময়ে স্থাপনার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নসরুল হামিদ বলেন, বড় অনেক ভবনে হাজার টনের বেশি এসি ব্যবহৃত হয়। কাচ দিয়ে ঘেরা ভবন, সব জায়গায় এসি। কামাল আতাতুর্ক সড়কের দুই পাশে ভবন উঠছে, সব প্রতিচ্ছবি দেখা যায়, এমন কাচের ভবন। কোনো না কোনো স্থপতি তো এগুলো করেছেন। তাদের মধ্যে কেন মাজহারুল ইসলামের দর্শন দেখা যায় না?
নসরুল হামিদ বলেন, মাজহারুল ইসলাম তাঁর স্থাপত্যের মাধ্যমে দেখিয়েছেন গণতন্ত্রের ভাষা কীভাবে তৈরি করা যায়। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ–২৮ এ গিয়ে মাজহারুল ইসলামের দর্শনেরই প্রতিফলন দেখা গেছে। তিনি মাটি, পানি ও গাছের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। এগুলো নিয়ে এখন কথা হয় কিন্তু কাজ হয় না। তাঁর দর্শনকে কাজে লাগানোর সময় এসেছে।
স্থপতি আদনান মোরশেদ আলোচনার শুরুতে মাজহারুল ইসলামের কাজ নিয়ে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মাজহারুল ইসলাম সমাজচিন্তক ছিলেন। যার ভাষা ছিল স্থাপত্য। তিনি জানান, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ভবনের কাজ করেন মাজহারুল ইসলাম। তিনি যখন এ কাজ করেন, তখন এ অঞ্চলে ঔপনিবেশিক ও ইউরোপীয় দুটি ধারা ছিল। কিন্তু মাজহারুল ইসলাম জলবায়ুকে মাথায় রেখে আধুনিকতাকে বেছে নিয়েছেন। এই স্থপতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করেছেন। তিনি তাঁর কাজে বাঙালি আধুনিকতার ধারা তৈরি করেছিলেন। শিক্ষা, গবেষণায় মাজহারুল ইসলাম এখনো অনুপস্থিত। তাঁকে নিয়ে ও তাঁর কাজ নিয়ে যে গবেষণা দরকার, তা হয়নি। গবেষণার পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকে তাঁর কাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও নগর গবেষণাকেন্দ্রের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, মাজহারুল ইসলামের নকশায় করা চারুকলা ভবনটি বিশ্ব স্থাপত্যের স্থান পাওয়ার যোগ্য। তিনি ‘মিনিস্ট্রি অব ফিজিক্যাল প্ল্যানিং’ নিয়ে যে প্রস্তাব করেছিলেন, সেটা খুঁজে বের করতে হবে। কোনো একক মন্ত্রণালয়কেই সবকিছু সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। এসবের জন্য সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী ও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যে আসতে হবে।
স্থপতি ও স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক সামসুল ওয়ারেস বলেন, ঔপনিবেশিকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নতুন পরিচয় তৈরি করেছিলেন মাজহারুল ইসলাম। মোগল স্থাপত্যের দিকে ঝোঁকেননি তিনি। তাঁর স্থাপত্যে প্রবেশদ্বার দিয়ে কোনো কিছু আটকে দেওয়া হয়নি। মানুষের ওপর তাঁর বিশ্বাস ছিল। তিনি স্থাপত্যের সঙ্গে শিল্পেরও সংযোগ ঘটিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে এখন সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেখানে কতটা মাজহারুল ইসলামের তৈরি করা স্থাপত্যের কারণে এবং কতটা অন্যদের কারণে, সেটাও আলোচনা হতে পারে। তিনি মানুষকে প্রগতিশীল হতে উৎসাহিত করতেন।
মাজহারুল ইসলামের নকশা করা বাড়িতে থেকেছেন জানিয়ে নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের বলেন, তাঁর কাজে প্রকৃতিকে খুব কাছে নিয়ে এসেছেন। দেশ দ্রুত নগরায়ণের দিকে যাচ্ছে। আবাসনগুলো আত্মকেন্দ্রিকতার দিক থেকে নির্মিত হচ্ছে। উন্মুক্ত স্থান এখন গুরুত্ব পায় না। মাজহারুল ইসলামের মতো মহান স্থপতি প্রকৃতিকে কাছে এনেছেন এবং এমনভাবে স্থাপত্য করেছেন, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ থাকে। ভবিষ্যতের জন্য হলেও এটা মাথায় রাখতে হবে।
বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী বলেন, ‘মাজহারুল ইসলাম একজন চিন্তাবিদ ও দার্শনিকও ছিলেন। তিনি আত্মপরিচয়কে দারুণভাবে তুলে ধরতেন। এখনকার সরকারি ভবন বা মানুষের জন্য যে ভবন, সেই ধারণা থেকে আস্তে আস্তে আমরা সরে আসছি। এত বাধা তৈরি হয়েছে যে এখন বলা যাবে না যে এটা মানুষের জন্য তৈরি হয়েছে। এটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক বলেন, একটা গাছ না কেটেও কীভাবে স্থাপনা করা যায়, তা দেখিয়ে গেছেন মাজহারুল ইসলাম। নগর উন্নয়নে মানুষের অংশগ্রহণ খুব দরকার। বিদেশের কোনো কিছু কপি করে বসালে হবে না। যেখানে স্থাপনা নির্মিত হবে, সেখানকার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
মাজহারুল ইসলাম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও স্থপতি ইসতিয়াক জহির বলেন, মাজহারুল ইসলাম সারা দেশ গোছানোর কথা বলতেন, ঐতিহ্যকে প্রাধান্য দিতেন। তাই উন্নয়নে মানুষের সম্পৃক্ততা রাখতে হবে। বিদেশি পরামর্শক কমাতে হবে। স্থানীয় জ্ঞান কাজে লাগাতে হবে।
স্থপতি মাজহারুল ইসলামের মেয়ে ডালিয়া নওশীন আলোচকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাঁর বাবার দর্শনকে আরও সহজভাবে দেখতে হবে এবং সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তিনি যেন সবার কাছে বোধগম্য হন এবং নতুন প্রজন্মের সঙ্গে যেন তাঁর সংযোগ ঘটে।