বঙ্গবন্ধু টানেলে সুফল পেতে বাধা সরু সড়ক
সেপ্টেম্বরে চালু হতে পারে বঙ্গবন্ধু টানেল। বিদ্যমান সড়ক দিয়ে যানবাহনের চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে দেশের প্রথম যোগাযোগ পথ (টানেল) দিয়ে যান চলাচল আগামী সেপ্টেম্বরে চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে টানেলের পূর্তকাজ শেষ হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে টোলের হারও। তবে টানেল ব্যবহার করে দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছার যে স্বপ্ন, তা হোঁচট খেতে পারে অপ্রশস্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কারণে।
ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে আসা যানবাহনকে টানেল হয়ে পর্যটন শহর কক্সবাজার, বান্দরবানসহ নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে এই মহাসড়ক ব্যবহার করতে হবে। ভবিষ্যতে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর এবং চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর চালু হলে এই মহাসড়কে গাড়ি চলাচলের পরিমাণ বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে মহাসড়কটির প্রশস্ততা গড়ে মাত্র ১৮ ফুট। টানেল চালু হলে গাড়ির চাপ বেড়ে যাবে। তখন এই অপ্রশস্ত মহাসড়কটি চাপ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহনবিশেষজ্ঞরা।
টানেল চালুর আগেই কিংবা টানেল নির্মাণের শুরুতেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্ত করা নিয়ে পরিকল্পনার দরকার ছিল; কিন্তু তা হয়নি। এখন টানেল দিয়ে গাড়ি যাবে ঠিকই; কিন্তু এরপর গাড়িগুলো কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবে, সে ব্যাপারে কারও পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হচ্ছে না। এই দূরদর্শিতার অভাবে অনেক সময় প্রকল্পের কার্যকর সুফল পুরোপুরি পাওয়া যায় না।
টানেল নির্মাণের অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। কিন্তু অপ্রশস্ত সড়কের কারণে এই উদ্দেশ্য পুরোপুরি সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এই মহাসড়কের দায়িত্বে থাকা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের প্রকৌশলীরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে মহাসড়কের প্রশস্ততা দ্বিগুণ করার কাজ চলছে। যদিও তা দিয়ে চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। ইতিমধ্যে টানেলের পূর্তকাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক (ইলেকট্রো মেকানিক্যাল) কাজ চলছে। সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে চীনের চায়না কমিউনিকেশনস অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল)। টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা। নগরের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ক রয়েছে। এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
ঢাকাসহ সারা দেশে থেকে আসা কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী গাড়ি চট্টগ্রাম টোল রোড ও চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে পতেঙ্গা দিয়ে টানেলে প্রবেশ করবে। সংযোগ সড়ক হয়ে এসব গাড়ি প্রথমে আনোয়ারার চাতরী চৌমুহনীতে সংযুক্ত হবে। এরপর গাড়িগুলো চলে যাবে পিএবি সড়ক হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা ওয়াই জংশনে। টানেলের সংযোগ সড়কের কাজ শেষ হলেও পিএবি সড়কের চাতরী চৌমুহনী মোড় থেকে আসা গাড়িগুলো শিকলবাহা ওয়াই জংশনে এসে মিশবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে। কিন্তু সেই মহাসড়ক এখনো দুই লেনের।
প্রথম আলোর আনোয়ারা প্রতিনিধি সরেজমিনে দেখেছেন, শিকলবাহা ওয়াই জংশনে গোলচত্বর নির্মাণ করা হয়েছে। এখানেই দুই লেনের মহাসড়কের সঙ্গে ছয় লেনের পিএবি সড়ক যুক্ত হয়েছে। মহাসড়কের দুই লেন দিয়ে চলছে বড়-ছোট বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। মহাসড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম নগর থেকে আসা গাড়ির একটি অংশ পটিয়ার দিকে ও আরেকটি অংশ আনোয়ারা প্রান্তে চলে যায়। আর মহাসড়কের পটিয়ার দিক থেকে আসা গাড়িগুলোর একটি চট্টগ্রাম নগরের দিকে ও আরেকটি অংশ আনোয়ারা চলে যায়।
ঢাকাসহ সারা দেশে থেকে আসা কক্সবাজার, বান্দরবান ও দক্ষিণ চট্টগ্রামমুখী গাড়ি চট্টগ্রাম টোল রোড ও চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড হয়ে পতেঙ্গা দিয়ে টানেলে প্রবেশ করবে। সংযোগ সড়ক হয়ে এসব গাড়ি প্রথমে আনোয়ারার চাতরী চৌমুহনীতে সংযুক্ত হবে।
দুই লেন করে চাপ সামালের চেষ্টা
১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের গড় প্রশস্ততা মাত্র ১৮ ফুট। দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে সড়কপথে যাতায়াতে এই মহাসড়ক ব্যবহার করতে হয়।
পর্যটন শহর কক্সবাজারে যাত্রীদের যাত্রা সব সময় সুখকর হয় না। কেননা, অপ্রশস্ত এই মহাসড়কের মোড়ে মোড়ে গাড়ির জটলা। বসে বাজার। যান চলাচলে শৃঙ্খলা নেই। কার আগে কে যাবে এ নিয়ে গাড়িগুলোর মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা। যানজটের কারণে এই পথ পাড়ি দিতে লেগে যায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা।
এই সড়কে প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার গাড়ি চলাচল করে। তবে ধীর গতির গাড়ি চলার কারণে উচ্চ গতির যানবাহন নির্দিষ্ট গতিসীমায় চলাচল করতে পারে না। সওজের প্রকৌশলীরা বলছেন, মহাসড়কের প্রশস্ততা কম হওয়ায় সড়কটিতে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটে। যানজটের কারণে গন্তব্যে যেতে মানুষের সময়ও বেশি লাগে। টানেল হলে এই চাপ আরও বেড়ে যাবে। আবার কক্সবাজারে সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ শিল্পায়নের প্রসারে চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। এগুলো পুরোদমে চালু হলে বিদ্যমান সড়ক চাপ নিতে পারবে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের মধ্যে কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চালু হতে পারে। আর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরসহ সারা দেশের কারখানার পণ্য কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরে আনা-নেওয়া করা যাবে। তখন প্রচুর পরিমাণ ভারী গাড়ি এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করবে।
সওজের দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সিংহ প্রথম আলোকে বলেন, টানেল চালু হলে গাড়ির চাপ বেড়ে যাবে। এ জন্য প্রাথমিক চাপ সামাল দিতে মহাসড়কের শিকলবাহা ওয়াই জংশন থেকে সাতকানিয়ার কেরানীহাট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার অংশ ১৮ ফুট থেকে ৩৬ ফুটে উন্নীত করার কাজ চলছে। এতে ১১০ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। তবে এই কাজ পুরোপুরি শেষ হতে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত লাগবে। তিনি মনে করেন, কক্সবাজার মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর চালু হলে মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার বিকল্প নেই। বর্তমান সড়ক দিয়ে যানবাহনের চাপ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
অর্থায়ন জটিলতায় আটকে আছে ছয় লেনের প্রকল্প
সওজের চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগ গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। তবে সরকারি তহবিল নাকি দাতা সংস্থা—কার অর্থায়নে সড়ক সম্প্রসারণের কাজ হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হয়নি।
সওজের একজন দায়িত্বশীল প্রকৌশলী প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বিপুল ব্যয়ের প্রকল্প অনুমোদন নিয়ে সংশয় রয়েছে। জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে যাতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত তা চূড়ান্ত হয়নি।
সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, টানেল চালুর আগেই কিংবা টানেল নির্মাণের শুরুতেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্ত করা নিয়ে পরিকল্পনার দরকার ছিল; কিন্তু তা হয়নি। এখন টানেল দিয়ে গাড়ি যাবে ঠিকই; কিন্তু এরপর গাড়িগুলো কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবে, সে ব্যাপারে কারও পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হচ্ছে না। এই দূরদর্শিতার অভাবে অনেক সময় প্রকল্পের কার্যকর সুফল পুরোপুরি পাওয়া যায় না।