‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ—এ কথা শুধু সমালোচনার জন্যই’
প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনকে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ বলে যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁরা সমালোচনার জন্যই শুধু সমালোচনা করছেন বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত ও প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই মন্তব্য করেন। আজ বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ। সেখানে প্রস্তাবিত আইনের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন সংবাদ সম্মেলনের সভাপতি আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ। উল্লেখ্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন আইসিটি বিভাগের অধীন।
বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পাঁচ বছর পর সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার সিদ্ধান্ত নেয়। গত সোমবার সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এখন খসড়াটি ভেটিং (আইনি যাচাই) সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবারও তা মন্ত্রিসভায় উঠবে। সরকারের লক্ষ্য, আগামী সেপ্টেম্বরে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আইনটি পাস করা। সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি গতকাল বুধবার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। এই খসড়ার সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই আইনের মধ্যে পরিবর্তন হলো প্রথমত শাস্তি কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে। দ্বিতীয়ত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধের (প্রমাণিত হলে) ক্ষেত্রে কারাদণ্ডের পরিবর্তে শুধু জরিমানার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (৩৩ ও ৫৭) প্রস্তাবিত আইনে একেবারে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই দুই ধারায় প্রথমটিতে ‘বেআইনিভাবে তথ্য-উপাত্ত ধারণ, স্থানান্তর ইত্যাদির দণ্ড’ সম্পর্কে বলা আছে। আর দ্বিতীয়টিতে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত কাজকর্ম’ সম্পর্কিত অপরাধের কথা বলা আছে। নতুন আইনের খসড়ায় মোট ধারা ৬০টি, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রয়েছে ৬২টি। প্রস্তাবিত আইনে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবারের জন্য যে সাজা, বারবার করলেও একই সাজা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সাজা বেশি রাখার বিধান রয়েছে।
কিন্তু বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে।
সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীদের অনেকে বলছেন, প্রস্তাবিত নতুন আইনে সাজা কমানো ও জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানোর বিষয়টি ইতিবাচক হলেও আইনের সংজ্ঞা আগের মতোই বহাল রাখায় অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সম্পাদক পরিষদ গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের চরিত্রগত পার্থক্য না থাকলে শুধু নাম বদল করে নতুন আইন করা অর্থহীন।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তনের প্রসঙ্গে টেনে বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় খসড়াটি ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে। তার মানে গতকালের আগপর্যন্ত মন্ত্রিসভার সদস্য ও কয়েকজন সচিব ছাড়া আগে কেউ জানতেন না। গতকাল পর্যন্ত যাঁরা এ নিয়ে মন্তব্য (কমেন্টস) করেছেন, তাঁরা এটি সম্পূর্ণটি জেনে মন্তব্য করেছেন, এ কথা বলা যাবে না। এটি (সাইবার নিরাপত্তা আইন) যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পাশাপাশি রাখা হয়, তাহলে অবশ্যই এটির পরিবর্তন করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘কিছু কিছু লোক যাঁরা সমালোচনা করেছেন, তাঁরা বলেছেন এটি (সাইবার নিরাপত্তা আইন) হচ্ছে “নতুন বোতলে পুরোনো মদ”। আমি বলতে চাই, ধরেন ২৯ ধারায় আগে ছিল জেল, এখন সেটি নেই। এখন শুধু জরিমানা আছে। এটি কি পরিবর্তন না? ২১ ধারায় জেল ছিল ১০ বছর। এখন হয়েছে ৭ বছর। এটাও কি পরিবর্তন না? এটাও আগের মতো আছে? আইনের সব জায়গায় দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে যে উপধারাগুলো (সাজা বেশি) ছিল, সেগুলো সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করা হয়েছে। সেটাও কি পরিবর্তন না? সেটাও কি এক আছে? এগুলো বিচার করার পর কেউ যদি বলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর সাইবার নিরাপত্তা আইন “নতুন বোতলে পুরোনো মদ”, তাহলে আমাদের বলতে হবে সমালোচনার জন্যই শুধু সমালোচনা করা হচ্ছে। এটি জেনে সমালোচনা করা হচ্ছে না।’
জামিনযোগ্য ধারা বাড়তে পারে
সাইবার নিরাপত্তা আইনে জামিনযোগ্য ধারা আরও বাড়তে পারে বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেসব ধারায় সাজার পরিমাণ অনেক বেশি ছিল এবং এ নিয়ে বেশ বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, সেগুলোর সাজা সাইবার নিরাপত্তা আইনে কমিয়ে আনা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বেশ কিছু ধারা জামিন অযোগ্য ছিল, সেগুলোকে নতুন আইনে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক ধারায় দ্বিতীয়বার অপরাধ করার জন্য সাজা দ্বিগুণ বা সাজার মেয়াদ বাড়ানোর বিধান ছিল। দ্বিতীয়বার অপরাধের ক্ষেত্রে বাড়তি সাজার কথা বলা আছে, সেগুলো নতুন আইনে বাতিল করা হয়েছে। যেটা জামিনযোগ্য করা হয়েছে, সেগুলো জামিনযোগ্য থাকবে, আর এটির সঙ্গে অন্য কিছু ধারা যোগ হতে পারে, সেটারও সম্ভাবনা আছে।
১৪ দিন পর্যন্ত মতামত গ্রহণ করা হবে
গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীন ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির ওয়েবসাইটে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি প্রকাশ করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা এটি (প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন) আলাপ শুরু করে দিয়েছি। ওয়েবসাইটে দেওয়ার মাধ্যমে মন্তব্যের আহ্বান জানাচ্ছি। আপনারা এখানে মন্তব্য করেন। গতকাল থেকে ১৪ দিন গণনা করা হবে। এই ১৪ দিন এটি ওয়েবসাইটে থাকবে। আর প্রয়োজন হলে কথা বলতে আপত্তি নেই, প্রয়োজন হলে আমরা অবশ্যই করব। আর আপনারা লিখিতভাবেও মতামত পাঠান। সেগুলো দেখে অবশ্যই বিবেচনার চেষ্টা করা হবে। আর এই আইনের বিষয়ে কথা যে কেউ বলতে পারেন এবং সেটি শোনার জন্য আমাদের সবার কান খোলা থাকবে।’
আনিসুল হক তাঁদের উদ্দেশে হলো সাইবার অপরাধ বন্ধ করা এবং তিনি মনে করেন অপব্যবহার সাইবার নিরাপত্তা আইনে বন্ধ হবে।
সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে কোনো অভিযোগ কাউকে আটকের দীর্ঘদিন পর প্রমাণ হয় অভিযোগ সঠিক ছিল না। কিন্তু এর ফলে ওই ভুক্তভোগীর জীবনের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। এ বিষয়ে কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকবে কি না। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি তাঁরা বিবেচনা করে দেখবেন।
যে কারণে নাম পরিবর্তন
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আমি আবারও বলছি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়নি, পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন যদি বলি বাতিল করা হয়েছে, তাহলে আপনারা প্রশ্ন করবেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব ধারাই তো এই আইনে (সাইবার নিরাপত্তা আইন) আছে। তাহলে আপনি কেন বলছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে? যে কারণে আমি পরিবর্তন শব্দটি ব্যবহার করছি। আসলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তনগুলো এতই বেশি ছিল যে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ পড়তে হতো, তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা (সংশোধন) আইনটিও সঙ্গে রাখতে হতো, এটা বিভ্রান্তি হতো। সে জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩, নামে নতুন করে করা হচ্ছে।’
আনিসুল হক বলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলে জনগণের মধ্যে একটি মানসিক চাপ থেকে যায়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশনে একটি মানসিক চাপ বা আতঙ্কের কথা বলা হয়েছিল। সেটাকেও ধর্তব্যের মধ্যে নেওয়া হয়েছে। যে কারণে সাইবার নিরাপত্তা আইন’ নামে আইনটি করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার,
লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিব মো. মইনুল কবির, একই বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক, ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান।