মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
বধ্যভূমি সংরক্ষণ প্রকল্পে গতি নেই
দেশজুড়ে ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের জুনে। এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৫টির কাজ শেষ হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল পাঁচ বছর আগে।
তবে এখনো এর কাজ শেষ করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের নেই নিয়মিত পরিচালক, জমি নিয়েও রয়েছে জটিলতা। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাই বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যে জনবল প্রয়োজন, তা নেই। শুধু দিবস এলেই এটি নিয়ে নড়েচড়ে বসে সবাই।
দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের পাশাপাশি সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য এ পর্যন্ত ৩৫টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। যদিও প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের জুন মাসে। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে প্রায় আড়াই বছর আগে। এরপরও কাজ শেষ হয়েছে ১২ শতাংশ।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সভায় প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্পটির পরিচালকের কাজ সামলান। এর আগেও যাঁরা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদেরও ছিল অতিরিক্ত দায়িত্ব।
বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম (খণ্ডকালীন অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের কাজ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রকল্পটি যেভাবে ডিজাইন (নকশা) করা হয়েছিল, সেভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। একদিকে জমি পাওয়া যাচ্ছে না, অন্যদিকে খাসজমি একসঙ্গে এত পরিমাণে নেই। অন্যদিকে কোথাও কোথাও কবর ও মন্দির রয়েছে।
‘১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ’ নামের প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ রাখা হয় ৪৪২ কোটি টাকা। দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে প্রতিটির জন্য ব্যয় ধরা হয় ৮০ লাখ ৯২ হাজার টাকা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কাজ এগিয়ে নিতে গণপূর্তসহ অন্যদের যে সহযোগিতা দেওয়ার কথা ছিল, তাদের সহযোগিতার অভাব রয়েছে। বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য যেসব জায়গা বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য নকশা অনুযায়ী ১৯ শতাংশ জমি লাগার কথা থাকলেও সেই পরিমাণ জমি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই জমির পরিমাণ ৬ থেকে ১৯ শতাংশ করে নকশায় পরিবর্তন আনা হয়। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবেও (ডিপিপি) এ জন্য সংশোধন আনতে হবে। এ ছাড়া বধ্যভূমির জন্য নির্ধারিত স্থানের অনেকগুলোতে জমির তফসিল, মৌজা, খতিয়ানে ওই দাগ নেই।
সূত্র বলছে, কিছুসংখ্যক বধ্যভূমির জমির তফসিল ও প্রকৃত বধ্যভূমির অবস্থানের সঙ্গে গরমিল রয়েছে। এ ছাড়া ডিপিপিতে যে জমির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা খাসজমি হলেও ব্যক্তিগত জমির মূল্য ধরা হয়েছে। আবার কিছুসংখ্যক খাসজমি ও ব্যক্তিগত জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো মূল্য ধরা হয়নি। এ ছাড়া এ প্রকল্পে কারা কাজ করবে, তা নিয়েও জটিলতা রয়েছে। যদিও সরকারি খাসজমিতে বধ্যভূমি থাকলে তা ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এক হাজার টাকার প্রতীকী মূল্যে বন্দোবস্ত নেওয়া এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে বধ্যভূমি থাকলে প্রচলিত অধিগ্রহণের নিয়ম অনুসরণ করার বিধান রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম থেকেই জমি পাওয়া যায়নি বলে ওই প্রকল্পে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে। জনবলের ঘাটতি রয়েছে, প্রকল্প পরিচালক তাঁর নিজের দায়িত্বের পাশাপাশি এ কাজ করেন।
এর আগে বিএনপি সরকারের সময় ২০০৪ সালে ৩৫টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত ওই প্রকল্পে ৬০ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু বেশির ভাগ বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়নি। যেগুলোতে করা হয়েছে, সেগুলো এখন বেহাল। ২০১০ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার আবার বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রকল্প হাতে নেয়। প্রথম থেকেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের।
সরেজমিন চিত্র
প্রকল্পের আওতায় ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিসহ যে ৩৫টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সেগুলোর মধ্যে তিনটি এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।
রংপুর অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দমদমা সেতুর পাশে দুই বছর আগে বধ্যভূমি সংরক্ষণসহ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পাশে এর অবস্থান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই স্থানে কারমাইকেল কলেজের চার শিক্ষক ও এক শিক্ষকের স্ত্রীসহ অনেককে হত্যা করা হয়।
মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, স্মৃতিস্তম্ভটির চারদিক ঘিরে রাখা হয়েছে। পাশ দিয়ে প্রবাহিত ঘাঘট নদ। পাশেই লক্ষ্মণপাড়া। মহাসড়ক থেকে স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত কাঁচা সড়কটির অবস্থা খুবই নাজুক। এটি পাকা করার দাবি জানান স্থানীয় লোকজন।
গণপূর্ত রংপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ৬৭ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয়ে দমদমা বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়।
২০২০ সালে বরিশালের বানারীপাড়ার দক্ষিণ গাভা নরেরকাঠি এলাকায় বধ্যভূমিস্থলে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী গাভা হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক বেণী লাল দাশগুপ্ত বলেন, ‘একাত্তরের ২ মের গণহত্যার পর আমরা ৭৩ জনের পরিচয় শনাক্ত করতে পেরেছিলাম। তবে আমার ধারণা, সেদিন অন্তত দেড় শ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।’ স্থানীয় মানুষজন স্মৃতিস্তম্ভ দেখভালের দায়িত্বে আছেন বলে জানালেন তিনি।
ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপার বগুড়া ইউনিয়নের কামান্না এবং আবাইপুর ইউনিয়নের আবাইপুর বাজারে রয়েছে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ। কামান্না মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠের পাশে স্মৃতিস্তম্ভ, সেটির পাশেই ‘২৭ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি সংঘ’। আর আবাইপুর বাজারে ১৯৭১ সালের ১৪ অক্টোবর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। স্থানীয় লোকেরা ১৮ জনের লাশ পেয়ে সেখানে কবর দেন। সেই ১৮ জন শহীদের নাম লেখা রয়েছে সেখানে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে।
আবাইপুর গ্রামের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা সবদুল মিয়া জানান, যে স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর দেওয়া হয়, সেই স্থানটি দীর্ঘ ৫১ বছর অবহেলিত ছিল। কবরগুলো আড়াল হয়ে গিয়েছিল ঝোপঝাড়ে। নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছিল এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা, রক্তাক্ত ইতিহাসের কথা। এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই শহীদদের অবদানের কথা সবাই স্মরণ করছে।
এটা দুঃখজনক
পাঁচ বছরেও বধ্যভূমিসমূহ সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণকাজ শেষ করতে না পারায় হতাশ মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকেরা। জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করতে পারল না, এটা দুঃখজনক।
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর, ঝিনাইদহ ও বরিশাল]