শহীদ আনাসের মায়ের লেখা
‘তোকে ছাড়া আমি ভালো নেই বাপ’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শহীদ হয় গেন্ডারিয়ার আদর্শ একাডেমির দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহারিয়ার খাঁন আনাস। তার মা সানজিদা খানের লেখা—
যে মা তাঁর কিশোর সন্তান হারান, সে মা তো সেদিনই মরে যান। বেঁচে থাকে শুধু মায়ের দীর্ঘশ্বাস আর সন্তানের সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষা। তোকে ছাড়া আমি ভালো নেই বাপ। তোকে ছাড়া আজ ১৪৯তম দিন...এভাবেই হিসাব কষি প্রতিনিয়ত।
আমার পরিচয়, আমি এখন শহীদ শাহারিয়ার খাঁন আনাসের মা। মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে অটোরিকশায় তোর গুলিবিদ্ধ লাশ কোলে করে বাসায় আনি। গত ৫ আগস্ট বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ১৬ বছর ৯ মাস বয়সী আমার ছেলেটাকে পুলিশ গুলি করে। বুকের বাঁ পাশে গুলি লেগেছিল। গুলিটা ছেলের বুকে লাগে।
সেই গুলি তো আমার কলিজাটাই ছিদ্র করে দিয়েছে। আমার জীবনের ছন্দ কেটে গেছে। বেঁচে থাকার আকুতি শেষ হয়ে গেছে।
আনাস, তুই চলে যাওয়ার পর দুই মাস তো বিছানা থেকেই নড়তে পারিনি। কিন্তু জীবনের তাগিদে বাঁচতে হচ্ছে। বাইরে থেকে আগে তুই সকালের নাশতা কিনে আনতি, এখন আমি আনি। তুই স্কুল থেকে ফিরবি, তাই দুপুরে আয়োজন করে রান্না করে তোর অপেক্ষা করতাম। এখন আমার কারও জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। তুই ফিরলে মা–ছেলে দুজন দুপুরের খাবার খেতাম আর গল্প করতাম। এখন একটা প্লেটে (থালা) ভাত নিই, তোর ছোট দুই ভাইকে খাইয়ে কোনো দিন নিজে দু–নলা মুখে দিই। আবার কোনো দিন কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। তুই প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস। ঘরের প্রতিটা কোনায় তোর স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই।
অস্থিরতা পেয়ে বসলে তোর কবরে ছুটে যাই, কত কথা বলি তোর সঙ্গে। তখন মনটা একটু হালকা হয়। যে দেশটাকে ভালোবাসলি, সেই দেশ তো তোর নিরাপত্তা দিতে পারল না।
যেদিন তোর জন্ম হয়েছিল, সে দিনটা ছিল ঈদের (পবিত্র ঈদুল ফিতর) দিন। তখন আমার বয়স মাত্র ১৮ বছর পার হয়েছে। আমরা তো শুধু মা-ছেলে ছিলাম না, ছিলাম দুই বন্ধু। আমরা তো বলতে গেলে একসঙ্গেই বড় হচ্ছিলাম। তুই আমার প্রথম সন্তান, সে এক অন্য রকম অনুভূতি। প্রয়োজন নেই, তারপরও তোর জন্য কত ‘ফিডার’ যে কিনেছিলাম। তুই চলেও গেলি আরেক বিজয়ের দিনে, যেদিন (৫ আগস্ট) শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর সবাই আনন্দ-উল্লাস করছিল। আমরা তখন তোর রক্তাক্ত লাশ নিয়ে দৌড়াচ্ছি।
তুই মায়ের ভালো লাগাকে সব সময় গুরুত্ব দিতি। তাড়াহুড়ো করে বাইরে চলে গেলে এসে দেখতাম ঘরটা তুই গুছিয়ে রেখেছিস। তুই জানতি মা এলোমেলো ঘর পছন্দ করে না। মারা যাওয়ার আগে নিজের কাজ নিজে করতিস মায়ের কষ্ট কমানোর জন্য। সেদিনও (৫ আগস্ট) ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চিঠি লিখে গিয়েছিলি। লিখেছিলি, ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য করে বের হোলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না...।’
আনাস বাবা, এ বছর শীতে তোকে হুডি (শীতের পোশাক) কিনে দিতে চেয়েছিলাম। মাকে তো একবারও বললি না, ‘মা হুডি কিনে দাও’। তোর শীত লাগে না? শীতের রাতে তোর গায়ে কম্বল জড়িয়ে দেওয়ার মুহূর্তটা তো আর আসে না। তোকে ছাড়া আমরা একা হয়ে গেছি। রাতে তোর বাবা বাইরে গেলে বলতে পারি না আনাসকে নিয়ে যাও। আমি একলা বাসায় থাকলে তোর বাবা বলতে পারে না, আনাস মায়ের সঙ্গে থাকো। আসলে তোকে ছাড়া আমাদের যে কষ্ট, তা কেউ কখনোই বুঝতে পারবে না।
তুই ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলি। গুলিতে মারা না গেলে তুইও অন্যদের সঙ্গে পরীক্ষা দিতি। তোর স্কুলের শিক্ষকেরা তোর সিটে (আসন) দুটো গোলাপ আর তোর বীরত্বের কথা লিখে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে ভাবি বুলেটের কাছে তুই হার মেনেছিস। তবে পরে আবার ভাবি বুলেট বুকে নিয়ে তুই তো পুরো দেশটাকেই জিতিয়ে দিয়ে গেছিস।
তোর জন্মদিন ছিল গত ১৪ অক্টোবর। সেভাবে কখনো বায়না করতিস না। তবে একটি চেক শার্ট চেয়েছিলি। ভেবেছিলাম এবার জন্মদিন উপলক্ষে একটি মুঠোফোন কিনে তোকে চমকে দেব। শার্টও কিনে দেব। তা আর হলো না।
জুরাইন কবরস্থানে তুই এখন তোর দাদির কবরে শুয়ে আছিস। গত বছর তোর দাদি মারা যাওয়ার কারণে তোর জন্মদিনে কেক আনা হয়নি। এবার তো কেক আনতে চেয়েছিলাম, তোর পছন্দের খাবার রান্না করতে চেয়েছিলাম, কিছুই করা হলো না। দেশকে ভালোবেসে মাকে এতটা না কাঁদালেও পারতি বাপ।
ঘরে বসে তুই আর আমি স্লোগান দিতাম ‘রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়’। সেই রক্তে আমার ছেলের রক্তও থাকবে, তা তো বুঝিনি। তোর মুখ থেকে কত দিন মা ডাক শুনি না, কত দিন তোকে দেখি না; মনে হয় পৃথিবীতে তোকে ছাড়া এক দিন এক দিন করে সাজা ভোগ করছি।
তুই তো চিঠিতে লিখেছিলি, ‘একদিন তো মরতেই হবেই। তাই মৃত্যুর ভয় কোরে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে না থেকে সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যুও অধিক শ্রেয়। যে অন্যের জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেয়, সেই প্রকৃত মানুষ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি, তবে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হয়ো।’
তোর জন্য আমার খুব গর্ব হয়। আমরা যা করতে সাহস পাইনি, তুই তা–ই করেছিস। যেখানে আছিস, সেখানে শুধু তুই ভালো থাকিস। হয়তো আবার একদিন আমাদের দেখা হবে, আবার আমরা ভালো বন্ধু হব।
আমাকে শহীদের মা হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আয়োজকেরা ডেকে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে শুনি ‘আনাস, সাঈদ, মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’। যুদ্ধটা এবার শেষ হোক।
আনাস, তোকে ছাড়া নতুন বছর শুরু হচ্ছে। যে বছরে আমার ছেলের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, সে বছর নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই, পরিকল্পনা নেই। তারপরও তুই ও তোদের মতো যে সন্তানদের রক্তে নতুন বাংলাদেশ পেলাম, সে বাংলাদেশটা ভালো থাকুক, তা–ই চাই।
অনুলিখন: মানসুরা হোসাইন