বাংলাদেশ দুঃসময়ের বন্ধুদের ভুলে যায় না: প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য জাপানের চারজন বিশিষ্ট নাগরিককে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’–এ ভূষিত করা হয়। সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) মিসেস গালপো ও পেমা গালপো, শেখ রেহানা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রয়াত রাজনীতিবিদ হিদেও তাকাতোর স্ত্রী ইয়ুকো তাকানো, তাদাতেরু কনোয়ে ও মিসেস কনোয়ে, প্রয়াত ফটোগ্রাফার ইচিনোসে তাইজোর নিকটাত্মীয় কিওকো জামা (সর্ব ডানে) । আজ টোকিওর আকাসাকা প্যালেসেছবি: পিআইডি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য জাপানের চারজন বিশিষ্ট নাগরিককে সম্মাননা পদক দেওয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের দেশের দুঃসময়ে বিদেশি যেসব বন্ধু আমাদের দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ কখনো তাঁদের ভুলে যেতে পারে না।’

প্রধানমন্ত্রী কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় জাপানের স্কুলশিক্ষার্থীরা টিফিনের পয়সা ত্রাণ তহবিলে দান করেছিল। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দেন যে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন জাপান সফরে এসেছিলেন, তখন শেখ রেহানা এবং ছোট ভাই শেখ রাসেল পিতার ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের তৃতীয় দিনে আজ টোকিওর আকাসাকা প্যালেসের রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। প্রয়াত রাজনীতিবিদ হিদেও তাকানো, অকালপ্রয়াত ফটোগ্রাফার ইচিনোসে তাইজো, বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস সোসাইটির সাবেক প্রেসিডেন্ট তাদাতেরু কনোয়ে এবং শিক্ষাবিদ পেমা গালপোকে ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার অনার’ সম্মানে ভূষিত করা হয়। প্রয়াত দুই সম্মানিত জাপানের নাগরিকের পক্ষ থেকে সম্মাননা পুরস্কার গ্রহণ করেন যথাক্রমে হিদেও তাকানোর স্ত্রী ইয়ুকো তাকানো এবং ইচিনোসে তাইজোর নিকটাত্মীয় কিওকো জামা। তাদাতেরু কনোয়ে ও পেমা গালপো সস্ত্রীক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

আমার অবদান ছিল খুবই সামান্য। তবে তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে আমাকে মনে রেখেছে সে জন্য আমি অভিভূত। এই বাস্তবতা প্রমাণ করছে যে এমনকি সামান্য ভালো কিছু আমরা করলেও কারও না কারও নজরে সেটা আসে।
পেমা গালপো, সম্মাননাপ্রাপ্ত জাপানের নাগরিক

অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব) কাজি সাজ্জাদ আলী জহীর বীর প্রতীক। সম্মানিত চার জাপানির জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত সম্মাননা সনদ পাঠ করে শোনান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন।

তাদাতেরু কনোয়ে দীর্ঘ সময় ধরে জাপান রেডক্রস সোসাইটির কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর এক মাস তিনি হাতিয়া দ্বীপে ত্রাণকাজ চালান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য জাপান রেডক্রসের পক্ষ থেকে সেবামূলক কাজে অংশ নেন তিনি।

পেমা গালপো জাপানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও মূলত একজন তিব্বতি। ১৯৭১ সালে ছাত্র থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে আলোড়িত করে। বন্ধু ও সহপাঠীদের নিয়ে বাংলাদেশের সহায়তায় অর্থ ও ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহে তিনি নিয়োজিত হন। সেই সময় টোকিওর পাকিস্তান দূতাবাসের বাংলাদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। সেই কূটনীতিকদের পক্ষ ত্যাগের পর বিভিন্ন উপায়ে তিনি তাঁদের সাহায্য করেন। জাপানের ছাত্রসমাজের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ন্যায্যতার বার্তা পৌঁছে দিতে বিভিন্ন উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করেন। এ জন্য তিনি নিউজ লেটার প্রকাশ করতেন।

প্রয়াত দুই জাপানির মধ্যে হিদেও তাকানো বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একাত্তরে তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সলিডারিটি কমিটি। তাঁরা শরণার্থীদের জন্য ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহ করতেন। বিভিন্ন সমাবেশ, অনুষ্ঠান ও প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের খবর সহানুভূতিশীল জাপানিদের কাছে পোঁছে দিতেন।

প্রয়াত অন্য সম্মানিত জাপানি ইচিনোসে তাইজো ছিলেন সুপরিচিত একজন ফটোগ্রাফার। ক্যামেরা হাতে নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন এলাকায় উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতির সচিত্র প্রতিবেদন জাপানিদের কাছে পৌঁছে দেওয়াকে ব্রত হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে কম্বোডিয়ার গৃহযুদ্ধের ছবি তোলার কাজে জড়িত থাকা অবস্থায় তিনি নিখোঁজ হন। তাঁর গুলিবিদ্ধ ক্যামেরার সন্ধান অনেক পরে পাওয়া গিয়েছিল। তাইজোর মৃত্যুর পর তাঁর মা নিজে উদ্যোগী হয়ে পুত্রের তোলা বিভিন্ন ছবির যে বই প্রকাশ করেন, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের বেশ কিছু ছবি সেখানে অন্তর্ভুক্ত আছে।

সম্মাননা লাভ করা চার জাপানির পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন পেমা গালপো। তিনি বলেন, তিনি নিজে একজন শরণার্থী হয়ে জাপানে এসেছিলেন বলেই হয়তো বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা করতে পারাকে নিজের দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। জাপান বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ দূতাবাসে তাঁদের সমবেত হওয়ার স্মৃতিচারণা করে পেমা গালপো বলেন, সদ্য স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীতের সঙ্গে পতাকা উঠেছিল, তখন লক্ষ করি যে কারোরই চোখ শুকনা নেই। আনন্দের অশ্রু নামছিল সবার চোখ বেয়ে।

অনুষ্ঠান শেষে প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে পেমা গালপো বলেন, ‘আমার অবদান ছিল খুবই সামান্য। তবে তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যে আমাকে মনে রেখেছে, সে জন্য আমি অভিভূত। এই বাস্তবতা প্রমাণ করছে যে এমনকি সামান্য ভালো কিছু আমরা করলেও কারও না কারও নজরে সেটা আসে।’