পাঠকের লেখা–৩৫
মারেইন-ইনগের বিয়ে ও কিছু কথা
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়।
আমি ১৯৯৯ সালের আগস্ট থেকে ২০০৩ সালের জুন পর্যন্ত বেলজিয়ামের গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত ছিলাম। থাকতাম ওবিএসজি নামের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ৫০ জন ছাত্রছাত্রীর বসবাস ছিল। আমাদের ডাইনিং-কিচেন ছিল কমন।
ছাত্রাবাসটি মূলত স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য। সারা দিন ক্লাস, ল্যাব শেষে রাতে যখন ছাত্রাবাসে ফিরতাম, তখন আমাদের বিশাল ডাইনিং-কিচেনে সবাই আনন্দমুখর পরিবেশে রাতের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম।
আমি সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পুরো সপ্তাহের মাছ-মাংস রান্না করে ছোট ছোট বক্সে পরবর্তী ছয় দিনের জন্য ডিপ ফ্রিজে রেখে দিতাম। কর্মদিবসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে রাইস কুকারে ভাত চড়িয়ে মাছ বা মাংসের বক্স মাইক্রোওভেনে দিয়ে টিভি দেখা ও কুশল বিনিময়ে মেতে উঠতাম। রান্না করা তরকারির ঘ্রাণে ছাত্রাবাসের অনেকেই আমার খাবারে ভাগ বসাত। অনেক সময়ই দেখা যেত, ছয় দিনের খাবার দুই দিনেই শেষ। আমিও আনন্দের সঙ্গে তাদের খাওয়াতাম। তারাও তাদের মাছ-সবজির মেনু শেয়ার করত, মাংসের ক্ষেত্রে যেহেতু হালাল-হারামের একটা ব্যাপার ছিল। আমার রান্নার সুখ্যাতি ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপক ফ্রান্স ডি কোর্টের তত্ত্বাবধানে আমরা পাঁচজন পিএইচডির ছাত্র ছিলাম। বেলজিয়ামের দিমিত্রি ও মারেইন, স্পেনের মিকাইল, ফ্রান্সের সেরিল এবং বাংলাদেশের আমি। মারেইন প্রস্তাব দিল, মাসে একবার আমরা কারও বাসায় অথবা ছাত্রাবাসে ডিনার অথবা লাঞ্চে মিলিত হব একে অপরের খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে। সবাই সমস্বরে রায় দিল আমার ছাত্রাবাসেই প্রথম প্রোগ্রাম আয়োজন করার। আমি আনন্দের সঙ্গে তাদের প্রস্তাবে রাজি হলাম।
পরবর্তী সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার ডিনারে নিমন্ত্রণ করলাম আমাদের তত্ত্বাবধায়ক ও তার স্ত্রী ইগনা, দিমিত্রি ও তার বান্ধবী বারবারা, মারেইন ও তার বান্ধবী ইনগে, সেরিল, মিকাইল এবং ল্যাব ইনচার্জ টনি ও তার স্ত্রীকে।
মেনু ঠিক করলাম পোলাও, মুরগির রোস্ট, জালি কাবাব, সবজি, নারকেল চিংড়ি, সালাদ, বোরহানি ও পায়েস। পেঁয়াজের বেরেস্তা পোলাও ও রোস্টের ওপর সাজিয়ে দিলাম। রান্নায় আমাদের ঐতিহ্যগত মসলাই ব্যবহার করলাম। শুধু ঝাল দিলাম পরিমিত।
নির্দিষ্ট সময়ে সবাই হাজির। খেতে বসে সবার চোখ ছানাবড়া। আমরা বাঙালিরা খাবারদাবারের আয়োজন অতিথির সংখ্যার চেয়ে বেশিই করে থাকি। সব খাবার চেটেপুটে শেষ করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সবার মন্তব্য, আমি তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছি। এর চেয়ে ভালো আয়োজন সত্যিই কঠিন। এর পর থেকে প্রতি মাসে আমরা একেক বাসায় আপ্যায়িত হয়ে নতুন নতুন খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকলাম।
এরই মধ্যে মারেইন ও ইনগের বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। ওদের বিয়েতে অতিথির সংখ্যা নির্ধারিত ৩০০ জন। মারেইন আমাকে ওদের বিয়ের আয়োজনের বিস্তারিত জানাল। দুপুরের আগে গির্জায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে। সন্ধ্যায় রিসেপশনের আয়োজনে তিনটি পর্ব থাকবে—ড্রিংকস, ডিনার ও কফি-ড্যান্স। মারেইন আমাকে প্রতিটি পর্বে অংশগ্রহণের নিমন্ত্রণ করে নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে যা বলল, তাতে কিছুটা অবাক হলাম। ওর বর্ণনায়, আমি কোনো কারণে অংশ নিতে না পারলে ওদের ৩০০ জনের নির্ধারিত তালিকার বাইরের তালিকা থেকে একজনকে নিমন্ত্রণ করবে। এভাবে ৩০০ জনের সংখ্যা নিশ্চিত করবে। কেউ কোনো কারণে ডিনারে আসতে না পারলে সে ডেজার্ট-কফি-ড্যান্স সেশনে অংশ নিতে পারে। কিন্তু অবশ্যই তাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমি সব পর্বে অংশ নিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।
বিয়ের দিন সন্ধ্যায় ড্রিংকস পর্বে ৩০০ জনের অনেক বেশি অতিথি উপস্থিত। মূল ডিনার পর্বে নির্ধারিত তালিকার ৩০০ জনের নাম ও খাবারের মেনু সুসজ্জিত ডাইনিং টেবিলে শোভা পাচ্ছে। অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ৩০০ আসনই পরিপূর্ণ। একজন অতিথি বা হোস্টও দাঁড়িয়ে নেই। নেই কোনো কোলাহল। অ্যাপিটাইজার, মেইন ডিশ ও ডেজার্ট দিয়ে ডিনার শেষে দেখলাম, পুরো হলে এতটুকু খাবারের অপচয় নেই। ডিনার শেষে রাত ১২টার পর আবার অনেক লোকের আগমন কফি-ড্যান্স পর্বে অংশ নিতে। ভোররাত পর্যন্ত এ পর্ব চলল।
আমার সহকর্মীদের মাধ্যমে জানলাম, যেসব অতিথি শুধু ড্রিংকস ও কফি-ড্যান্স পর্বে অংশ নিয়েছে, তারা ডিনারে নিমন্ত্রণ পায়নি। তারা মারেইন-ইনগের আর্থিক সক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল এবং ৩০০ জনের তালিকার বাইরের নিমন্ত্রিত অতিথি। এটাই তাদের সংস্কৃতি, তারা এতে কিছু মনে করে না।
হলফ করে বলতে পারি, আমাদের দেশে হলে অতিথির সংখ্যা বেশি হতো কিংবা কম হতো। খাবারের টানাটানি পড়ত, নতুবা অপচয় হতো। আমরা কবে বাস্তববাদী হব?
সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেন, সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন