মূল্যস্ফীতির তুলনায় ঘুষ বাড়ছে না, ঘুষখোরেরা চলবেন কী করে!

দুর্নীতিপ্রতীকী ছবি

এক.

ব্যক্তির জিবের নিচে মধু থাকলে তিনি তার স্বাদ নেওয়া ছাড়া যেমন থাকতে পারেন না, তেমনি রাজ্যের অর্থসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত একজন কর্মচারী অল্প হলেও রাজার অর্থ আস্বাদন ছাড়া থাকতে পারেন না’—কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় অধিকরণের নবম অধ্যায়ে ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে যা বলা হয়েছে, তার সারমর্ম এটা।

প্রাচীন ভারতীয় পণ্ডিত ও দার্শনিক কৌটিল্য (খ্রিষ্টপূর্ব: ৩৭১-২৮৩) বেশি পরিচিত চাণক্য নামে। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম মৌর্য বংশীয় সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধান মন্ত্রী। তাঁর লেখায় দেখা যাচ্ছে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই রাজার কোষাগার অথবা জনগণের পকেট থেকে কিছু অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভ্যাস রাজকর্মচারীদের ছিল।

রাজারা বিদায় নিয়েছে, ব্রিটিশরা গেছে, পাকিস্তানিরা বিতাড়িত হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে যা রয়ে গেছে, তা হলো ঘুষ।

দুর্নীতি প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি জাতীয় খানা জরিপ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, করোনার বছর ২০২১ সালে দেশের একেকটি খানার গড় ‘ঘুষব্যয়’ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা। ২০২১ সালে জাতীয়ভাবে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা।

খানা কী, সেটাও একটু জেনে রাখি। খানা বলতে বোঝায় মূলত পরিবারকে। এক চুলায় যে কয়জন সদস্যের রান্না হয়, তারা মিলে এক খানা। সর্বশেষ জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে এখন খানার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ।

দুই.

মানুষের করের টাকায় সরকার যে কাজের জন্য কর্মচারীকে বেতন দেয়, সেই মানুষের কাছ থেকে কাজের বিনিময়ে ঘুষ নেওয়ার কাজটি সহজ নয়। এ জন্য মিথ্যা কথা বলতে হয়, মানুষকে ঘোরাতে হয়, নানা পথঘাটের পানি খাওয়ানোর হুমকি দিতে হয়, ছ্যাঁচড়া হতে হয়। তারপরই কেবল মানুষ পকেট থেকে অর্থ বের করে দেয়।

যা-ই হোক, টিআইবির জরিপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশে আসলে মানবতা নেই! মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) যে হারে বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, সে হারে মানুষ ঘুষ বাবদ ব্যয় করছে না। ফলে ঘুষখোরদের পকেটে প্রত্যাশিত (!) হারে অর্থ যাচ্ছে না।

টিআইবি বলছে, ২০১৭ সালে প্রতিটি পরিবারকে গড়ে ঘুষ দিতে হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩০ টাকা, যা ২০২১ সালে চার বছর পরে মাত্র ৭০৬ টাকা বেড়েছে। এই চার বছরে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। বিপরীতে ঘুষব্যয় বাড়ার হার মাত্র ১২ শতাংশ। এটা কোনো কথা!

২০১৭ থেকে ২০২১ সময়ে দেশের জিডিপির হার বেড়েছে অন্তত ২৮ শতাংশ। বিপরীতে প্রকৃত ঘুষব্যয় না বাড়ায় দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল (!) ঘুষখোরেরা পাননি।
তিন.

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে প্রতিবছর বাজেটের আগে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) একটি সভা হয়। সেখানে ব্যবসায়ীরা প্রতিবছরই করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন, যাতে কর না বাড়লেও সরকারের রাজস্ব বাড়ে।

এই পরামর্শ এনবিআর কতটুকু নিয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে ঘুষখোরেরা যে আওতা বাড়ানোর পথে হেঁটেছেন, তা স্পষ্ট টিআইবির জরিপে। সংস্থাটির প্রতিবেদন বলছে, ২০১৭–এর তুলনায় ২০২১ সালে দুর্নীতির শিকার পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। এ সময়ে দুর্নীতির শিকার পরিবার সাড়ে ৬৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ দশমিক ৮ শতাংশে। মানে হলো, আরও বেশি পরিবারকে ঘুষের আওতায় এনে ঘুষখোরেরা তাঁদের আয় বাড়িয়েছেন। ফলে মোট জাতীয় ঘুষ বেড়েছে ১৩৩ কোটি টাকা। যদিও ২০১৭ সালের তুলনায় বৃদ্ধির হার মাত্র ১ শতাংশের কিছু বেশি।

দেশে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদেশ যাওয়ার খরচ বেড়েছে। গাড়ি, বাড়ির দাম বাড়ছে। এ সময় ঘুষের হার না বাড়লে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা সংসার চালাবেন কী করে—বিষয়টি ভাবার কি কেউ নেই!

চার.

‘ঘুষের ক্ষমতাকে কখনো ছোট করে দেখবেন না’—উক্তিটি ব্রিটিশ সাংবাদিক ফ্রান্সিস ক্লদ কুকবার্নের (১৯০৪-১৯৮১)।

বাংলাদেশে ঘুষ কতটা কার্যকর, তা প্রতিদিন ‘হাড়ে হাড়ে’ টের পায় দেশের মানুষ। গত সপ্তাহে পরিচিত একজন গিয়েছিলেন মোটরসাইকেলের মালিকানা পরিবর্তন করতে। সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর কাছে গিয়ে বিষয়টি বলতেই তিনি বললেন, পুলিশ ‘ভেরিফিকেশন’ লাগবে। নানাভাবে অনুনয়, একই এলাকায় গ্রামের বাড়ির পরিচয় দেওয়ার পর ওই কর্মচারী কাগজের কোনায় লিখলেন, ‘১,৫০০’। সম্মতি সূচক মাথা নাড়ানোর পর আর পুলিশ ‘ভেরিফিকেশন’ লাগল না। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেল মোটরসাইকেলের নাম পরিবর্তন।

মিল খোঁজার চেষ্টা না করে ঢাকার কয়েকটি দিক মাথায় নিতে পারি। তাহলেই বুঝতে পারব ঘুষ কার্যকর কি না।
ক.
আইনে যানবাহনের ফিটনেস নিয়ে বিপুল শর্ত দেওয়া আছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো বিআরটিএ কর্মকর্তা ও ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে কীভাবে চলছে?
খ.
এত ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও বিআরটির কর্মকর্তা থাকার পরও ঢাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা মিটারে চলাচল কেন নিশ্চিত করা গেল না?
গ.
ট্রাফিক পুলিশ কেন এসব বাস বাদ দিয়ে পণ্যবাহী যানবাহন দেখলেই হামলে পড়ে।

অবশ্য ঘুষ যে সব সময় কাজ করে, তা নয়। অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে ‘“শুয়োরের বাচ্চাদের” অর্থনীতি’ অংশে ব্রিটিশ ভারতে আসানসোল মহকুমা প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটের সঙ্গে এক পাঞ্জাবি ঠিকাদারের কথোপকথন তুলে ধরে বলেছেন, দেশে তিন কিসিমের লোক আছে—১. যাঁরা সজ্জন, ঘুষ খান না। ২. বদলোক, যাঁরা ঘুষ খায়। ৩. শুয়োরের বাচ্চা, যাঁরা ঘুষ নেয়, কিন্তু ঘুষদাতাকে কোনো সহযোগিতা করে না।’

দেশে শুয়োরের বাচ্চা যে কম নেই, তা প্রায়ই খবরে উঠে আসে। টাকা নিয়ে চাকরি না দেওয়ার অভিযোগ এর একটি উদাহরণমাত্র।

এই তিন কিসিমের লোকের মধ্যে এখন এক কিসিমের লোকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। অতি বিপন্ন কিসিমের মধ্যে রয়েছেন সজ্জন মানুষেরা, যাঁরা ঘুষ নেন না। কয়েক বছর আগে ঢাকায় এক আলোচনা সভায় একজন সাবেক আমলা (নাম মনে নেই) বলেছিলেন, প্রশাসনে যখন দুর্নীতিবাজের সংখ্যা বেড়ে যায়, তখন তাঁরা সৎ ব্যক্তিদের প্রতিহত করেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিনের চাকরিচ্যুতির ঘটনাটি এই লেখার সঙ্গে মিলিয়ে না দেখার অনুরোধ করছি।

সবাই মিলে যে দুর্নীতি করা হচ্ছে, তা অনেকটা উঠে এসেছে সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের এক বক্তব্যে। প্রকল্পের গাড়ি পরিবহন পুলে জমা না দিয়ে ব্যবহার নিয়ে একটি অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘একটা গাড়ি তো পুল থেকে পেয়েছি। ওর সঙ্গে ফ্যামিলির জন্য একটা গাড়ি দেয়। বর্তমান সচিবও ব্যবহার করছেন। সব সচিবই অ্যাডিশনাল সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গাড়িটা নেয় আরকি।’

উল্লেখ্য, সরকারি প্রকল্পের কোটি টাকা দামের গাড়ি পরিবহন পুলে জমা না দিয়ে আমলারা সেটা ব্যবহার করেন। স্ত্রী-সন্তানকে ব্যবহার করতে দেন। সরকারের টাকায় জ্বালানি তেলের ব্যয় ও চালক সুবিধা নেন। যদিও সরকার এই করোনাকালে তাঁদের প্রাইভেট কার ও ফ্ল্যাট কেনার জন্য সুদে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কোনো কৃচ্ছ্রসাধন হয়নি।

প্রকল্পের গাড়ি কোথায় কয়টি আছে, তা–ও জানা নেই সরকারের।

পাঁচ.

‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’—লিখেছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি কবি ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২-১৭৬০)। তিনি ছিলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাসদ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে ‘রায়গুণাকর’ উপাধি দিয়েছিলেন। রম্য গল্পকার, ভাঁড় ও মনোরঞ্জনকারী গোপাল ভাঁড়ও ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ।

যা-ই হোক, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ কথাটির মূল বক্তব্য হলো, বড় বিপদ যখন আসে, তখন কেউ রক্ষা পায় না, সেটা দেবালয় হলেও। তেমনি এখন ঘুষ-দুর্নীতি থেকে কেউ রক্ষা পাচ্ছে না। সরকারি কর্মচারীদের কথাই বলা যাক—তাঁদের সরকারি বাসা পেতে যে লাখ লাখ টাকা ঘুষ লাগে, সেটা কান পাতলেই শোনা যায়।

ঢাকা যে পৃথিবীর অন্যতম বাসযোগ্যতাহীন শহর, সেই শহরে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে রাজউকের কর্মকর্তা, ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের থাকতে হয়, দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিতে হয়, যানজটে আটকে থাকতে হয়। অবশ্য কেউ কেউ নিজের পরিবারকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় রেখেছেন। কিন্তু তিনি নিজে যে শ্বাস নিচ্ছেন, সেই বায়ুতে ‘বিষ’ রয়েছে।

ঢাকার চারপাশের নদ–নদী বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা দূষিত হয়ে পড়েছে শিল্পবর্জ্যে, পয়োবর্জ্যে। সেই নদীর পানিতে উৎপাদিত চাল, সবজি যে সরকারি লোকেদের স্ত্রী, সন্তানদের পেটে যাচ্ছে না, সে নিশ্চয়তা কে দেবে।

ঘুষ-দুর্নীতির কারণে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হলেও মনে রাখা উচিত, তিনিও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।

ছয়.

ঘুষ, দুর্নীতি দূর করতে হবে নিজের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য। তবে কাজটি সহজ নয়। আকবর আলি খান ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ে লিখেছেন, নিজেদের দুর্নীতি হ্রাসে সরকারি কর্মচারীদের কোনো আগ্রহ নেই; তাঁদের অনেকেই দুর্নীতির প্রধান পোষক। রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই দুর্নীতি দূর করতে চান। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের প্রতিরোধের সামনে তাঁরা অকার্যকর; অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দুর্নীতি দূর করতে তাই প্রয়োজন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন।

আকবর আলি খান আরও লিখেছেন, ‘উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে তাদের সরকারকে বলতে হবে, “হুজুর আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়োরের বাচ্চাদের সামলান”।’

‘শুয়োরের বাচ্চা’দের ঘুষের সুবিধাভোগী স্ত্রী বা স্বামী, সন্তানদের সেই সক্ষমতা আর আছে কি না, সরকারের সেই নৈতিক শক্তি ও জনগণ থেকে উৎসারিত রাজনৈতিক ভিত্তি আছে কি না, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

*লেখক: রাজীব আহমেদ, প্রথম আলোর ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং