তুরস্কের ভূমিকম্প আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে
ভূমিকম্প নিয়ে কমবেশি আতঙ্ক সবার মধ্যেই আছে। ছবির মতো সুন্দর তুরস্কে ভূমিকম্পে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশেও অনেকে আতঙ্কে ভুগতে পারেন। এতটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, ওই ভূমিকম্পের প্রভাব আর যা–ই হোক, বাংলাদেশে পড়বে না। তুরস্কের আনাতোলিয়ায় যে ভূগর্ভস্থ চ্যুতি বা ফল্ট রয়েছে, সেখান থেকে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়েছে। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ওই ফল্ট বেশ সক্রিয়। সেখান থেকে এ ধরনের শক্তিশালী ভূমিকম্প সৃষ্টির সম্ভাবনা বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিলেন।
তবে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার চেয়ে এ সম্পর্কে সচেতন হওয়া বেশি জরুরি। ভবন বানানোর সময় যথাযথ বিল্ডিং কোড মেনে চলা, সর্বোপরি ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে করণীয় কী, সেসব জানা জরুরি।
পৃথিবীর উপরিভাগকে ভূত্বক বলে। এই ভূত্বকে কোনো ফাটল (ফল্ট) বরাবর শিলারাশির হঠাৎ স্থানচ্যুতি হলে ভূপৃষ্ঠে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়, তাকেই আমরা ভূমিকম্প বলি। ভূমিকম্প নতুন ফাটল তৈরি বা বিদ্যমান ফাটলকে সক্রিয় করে থাকে। সাধারণত বিদ্যমান ফাটল দিয়ে সঞ্চিত শক্তি নির্গত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। ফাটল দৈর্ঘ্যে কম হলে স্থানচ্যুতির পরিমাণ কম হবে। কিন্তু এটি বড় হলে স্থানচ্যুতির পরিমাণ বেশি হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভূমিকম্পের মাত্রাও বেশি হবে।
তাহলে শিলারাশির স্থানচ্যুতির জন্য ভূ-অভ্যন্তরে প্রচণ্ড শক্তির প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় ধরে এই শক্তি চলমান প্রক্রিয়ায় ভূত্বকের মধ্যে সঞ্চিত হচ্ছে। এই শক্তি ভূত্বকের শিলার সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করলেই নতুন ফাটল সৃষ্টি বা পুরোনো ফাটল সক্রিয় হয়। তা ফাটল দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করে। আর এ সময়ই ভূমিকম্প হয়। সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ যত বেশি হবে, ভূমিকম্পের মাত্রা তত বেশি হবে। ভূত্বকে এই শক্তির জমা হওয়া নির্ভর করে সময় ও প্লেটের গতির ওপর। স্বল্প সময়ে কম শক্তি এবং দীর্ঘ সময়ে বেশি শক্তি ভূত্বকে জমা হয়। ভূমিকম্প, অগ্ন্যুত্পাত, পাহাড়, পর্বতের সৃষ্টি—এই সবকিছুই করে থাকে টেকটোনিক প্লেট।
বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ভারত প্লেট, উত্তরে তিব্বত উপপ্লেট এবং পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে বার্মা উপপ্লেট। ভারত ও বার্মা প্লেটের সংযোগ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে গেছে। পূর্ব অংশটি বার্মা প্লেট এবং পশ্চিমাংশ ভারতীয় প্লেটের অন্তর্গত। শিলং মালভূমি ভারত প্লেটের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি প্লেট। এটি দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলেছে ধীরে ধীরে। ভূতাত্ত্বিক গঠন ও টেকটোনিক কাঠামোর কারণেই বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। বিশেষ করে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ এবং পার্শ্ববর্তী দেশের ভূতাত্ত্বিক ও টেকটোনিক কাঠামো বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যায়, সুদূর ও নিকট অতীতে এ অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও পার্শ্ববর্তী এলাকার (উত্তর ও পূর্ব দিকে) ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি রয়েছে। পূর্বাংশের পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকসন জোন, যেখানে ভারতীয় প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণে এসব ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি ও সাবডাকশন জোনে বিপুল শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। গত ৪০০ বছরে সাবডাকশন জোন ও চ্যুতিগুলো থেকে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর গতিপথের পরিবর্তন হয়েছে। সাবডাকশন জোন থেকে সংঘটিত ভূমিকম্প সবচেয়ে ভয়ংকর। জনবহুল নগর ঢাকা ভূমিকম্পের সক্রিয় দুটি প্রধান উত্স, উত্তরে ডাইকি চ্যুতি ও পূর্বে ইন্দো-বার্মা সাবডাকশন জোন থেকে ৫০–২০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত।
২০১০ সালে হাইতিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্ট হয়। এরপর মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে চিলিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃত্যু হয় ৫২৫ জনের। ২০১৫ সালে নেপালে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৯ হাজার জনের মৃত্যু ও বিপুল পরিমাণ সম্পদের ক্ষতি হয়। ৭০০ কিলোমিটার দূরের নেপালের ভূমিকম্পের আতঙ্কে বাংলাদেশে ৬ জনের মৃত্যু হয়। হাইতিতে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭। আর চিলির ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮।
এ রকম আলোচনার আরও অনেক কারণ আছে। ১৮৯৭ সালে ডাউকি ফল্টে সংঘটিত ৮ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিল ১ হাজার ৬২৬ জন। মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে ওই ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা যাবে না। কারণ, ওই সময় জনসংখ্যার ঘনত্ব ও স্থাপনা ছিল খুব কম। তবে ওই ভূমিকম্প পুরো ভারতবর্ষে আঘাত হেনেছিল এবং ক্ষতি সাধন করেছিল। একই মাত্রার ভূমিকম্প বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় বা এর আশপাশে হলে কী ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা কল্পনা করলে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। কারণ, ঢাকা শহরে কেবল পুরোনো নয়, অতি পুরোনো অনেক ভবনও রয়েছে এবং সেসব ভবনে ঝুঁকি নিয়েই অনেক মানুষ বসবাস করছেন।
চিলির ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি এবং মৃত্যুর সংখ্যা হাইতি ও নেপালের চেয়ে কম হওয়ার কারণ, চিলির ভবনগুলোর নির্মাণশৈলী অনেক বেশি টেকসই। এ ছাড়া হাইতির ঘনবসতি চিলির তুলনায় বেশি, তাই নিহত ব্যক্তির সংখ্যাও অনেক বেশি। বাংলাদেশের তুলনায় চিলির আর্থসামাজিক অবস্থা অনেক উন্নত। কাজেই একই মাত্রার ভূমিকম্পে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী হবে, তা চিলির সঙ্গে তুলনা করে বোঝার উপায় নেই।
তাই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার জন্য এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সরকারকেই এ বিষয়ে মুখ্য দায়িত্ব পালন করতে হবে, যাতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ন্যূনতম পর্যায়ে থাকে। একটি ভবন নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সব নিয়ম মেনে করছে কি না, তা কঠোরভাবে তদারক করতে হবে।
লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়