বন্যাকবলিত এলাকায় গর্ভপাত বৃদ্ধির শঙ্কা, গবেষণা বলছে ঝুঁকি ৮% বেশি
পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। ফেনীতে সাম্প্রতিক বন্যায় তাঁর বাড়িতে পানি ওঠে। বাড়ির কর্তা মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী। ওই নারী তিন সন্তান নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। চিকিৎসকেরা গর্ভের সন্তানের সুরক্ষার কথা ভেবে তাঁকে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু বন্যায় ঘরের কিছু রক্ষা করতে পারেননি বলে দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না তাঁর।
৩ সেপ্টেম্বর ওই নারী (৩৫) রক্তস্রাবের (ব্লিডিং) কারণে ফেনীর পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। পরে চিকিৎসাসেবার মধ্য দিয়ে ওই নারীর গর্ভের মৃত সন্তানকে বের করে আনা হয়।
এ ঘটনার তিন দিন আগে একই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী আসেন। তাঁর গর্ভের ভ্রূণও টিকিয়ে রাখা যায়নি। বন্যার সময় বুকসমান পানি ঠেলে অন্যের বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন ফেনীর সদর উপজেলা ও ফুলগাজী উপজেলার ২৬ ও ৩২ বছর বয়সী দুই অন্তঃসত্ত্বা নারী। এর কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁদের গর্ভপাত হয়। এরপর দুজনকে ফেনী সদর উপজেলায় অবস্থিত মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
গর্ভপাত হয়েছে ভয় ও আতঙ্ক থেকে। বন্যার পানিতে দ্রুত বাড়িঘর ডুবে যাওয়া দেখে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি এমন ছিল যে তাঁদের পক্ষে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিলেও পর্যাপ্ত খাবার ও যত্ন পাননি।জাহানারা সুলতানা মজুমদার, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ, পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় ভয়, আতঙ্ক, সম্পদের ক্ষতির কারণে মনখারাপ, পুষ্টিকর খাদ্য ও যত্নের অভাব এবং চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ায় ওই নারীদের গর্ভপাত হয়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, এ ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে বাংলাদেশসহ ৩৩টি উন্নয়নশীল দেশ নিয়ে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গর্ভপাতের ঝুঁকি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি থাকে।
ঝুঁকি ৮ শতাংশ বেশি
বন্যার কারণে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকি নিয়ে এ বছরের ২ জানুয়ারি চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদন বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ‘নেচার কমিউনিকেশনস’–এ প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, গর্ভাবস্থায় যে নারীরা বন্যার মুখোমুখি হন, তাঁদের গর্ভপাত ও মৃত সন্তান প্রসবের হার বা গর্ভাবস্থা হারানো অন্য এলাকার অন্তঃসত্ত্বা নারীদের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। ‘ফ্লাড এক্সপোজার অ্যান্ড প্রেগন্যান্সি লস ইন ৩৩ ডেভেলপিং কান্ট্রিজ’ শিরোনামের ওই গবেষণায় বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল এই দেশগুলোতে গর্ভপাতের ৯০ হাজার ৪৬৫টি ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বন্যার কারণে প্রতিবছর স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত ১০ লাখের বেশি গর্ভাবস্থা হারানোর ঘটনা ঘটেছে। আর বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতিতে বছরে প্রতি ১০ হাজারে আগের তুলনায় অতিরিক্ত ২০ জন নারী গর্ভাবস্থা হারান। এ ঘটনাগুলো বেশি ঘটে দরিদ্র ও কম শিক্ষিত পরিবারগুলোতে এবং গ্রামের নারীদের মধ্যে।
যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য অধিকারবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গাটমাকার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ সম্পর্কে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের তথ্য দিয়েছে। সেই তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বছরে ৫৩ লাখ ৩০ হাজার নারী গর্ভধারণ করেন এবং ১৫ লাখ ৮০ হাজার গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, এবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার সংখ্যা ১১টি। এর মধ্যে রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫১ লাখের বেশি।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) তথ্যানুসারে, প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ২২ থেকে ২৪ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী থাকেন। সেই হিসাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা এক লাখের বেশি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) তথ্যানুসারে, প্রতি হাজার মানুষের মধ্যে ২২ থেকে ২৪ জন অন্তঃসত্ত্বা নারী থাকেন। সেই হিসাবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীর সংখ্যা এক লাখের বেশি হতে পারে।
আতঙ্ক, উদ্বেগ থেকে গর্ভপাত
ফেনীর পরশুরাম উপজেলায় গর্ভপাত হওয়া দুই নারীর চিকিৎসা করেছিলেন পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট মোসা. জাহানারা সুলতানা মজুমদার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দুটো গর্ভপাতই হয়েছে ভয় ও আতঙ্ক থেকে। বন্যার পানিতে দ্রুত বাড়িঘর ডুবে যাওয়া দেখে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি এমন ছিল যে তাঁদের পক্ষে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিলেও পর্যাপ্ত খাবার ও যত্ন পাননি।
ফেনীর মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা আশরীন সুলতানা দুই অন্তঃসত্ত্বা নারীকে গর্ভপাতের পর ডিএন্ডসি (জরায়ু পরিষ্কার করে দেওয়া) সেবা দেওয়া হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ওই দুজন বন্যার সময় শারীরিক ও মানসিক কষ্টে ছিলেন। তাঁদের আলট্রাসনোগ্রাম প্রতিবেদন থেকে বোঝা গিয়েছিল, গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট হয়েছে। কেন্দ্রের ইনচার্জ ও চিকিৎসা কর্মকর্তা (ক্লিনিক) নাসরীন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার সময় স্বাভাবিক সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের গর্ভাবস্থা জটিল আকার ধারণ করেছে। একটি ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ওই নারীর গর্ভে যমজ সন্তান ছিল। বন্যার সময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সাত মাসের গর্ভাবস্থায় তাঁর ব্যথা উঠে যায়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হলে অপরিণত ও কম ওজনের নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখতে হবে। তাঁদের হাসপাতালে এই সুবিধা না থাকায় ওই নারীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাঁর সন্তান প্রসব হয়।
যদিও দাগনভূঞা উপজেলা হাসপাতালে এ সময়ে গর্ভপাতের কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েনি বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে জানান, এ এলাকার লোকজন এ ধরনের ভয়াবহ বন্যা দেখে অভ্যস্ত নন বলে আতঙ্কে বেশি ভুগেছেন। তাই এ ধরনের দুর্যোগে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের বিষয়ে আগে থেকেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০ আগস্ট থেকে বন্যার পানি বাড়ি বাড়ি ঢুকতে শুরু করে। এরপর মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, আতঙ্ক, ভোগান্তি শুরু হয়। মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে থাকেন। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি হয়। তাই বন্যার কারণে গর্ভপাতের বিষয়টি পুরো চিত্র পেতে সেপ্টেম্বরের পরিসংখ্যান পাওয়া জরুরি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, চলতি মাসের গর্ভপাত নিয়ে প্রতিবেদনটি এখনো তৈরি হয়নি। এ মাসে গর্ভপাত–পরবর্তী সেবার হার বাড়লে বুঝতে হবে, বন্যায় গর্ভপাত বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, সাধারণভাবে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ থেকে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে।