স্বাস্থ্য রক্ষায় চাই নাগরিক সক্রিয়তা

রাজনৈতিক পরিসরে স্বাস্থ্য যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না। সামাজিক আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়ছে।

দেশের রাজনীতিতে ও রাজনীতিবিদদের কাছে স্বাস্থ্য যথাযথ গুরুত্ব পায় না। স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন আনতে ভবিষ্যতে নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব হবে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন। ‘স্বাস্থ্য খাতে আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি: একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠক যৌথভাবে আয়োজন করে নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও প্রথম আলো। বৈঠকে অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ, ওষুধবিশেষজ্ঞ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নারী অধিকার কর্মী ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পিপিআরসির নির্বাহী সভাপতি হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, আগামী নির্বাচনের পর নতুন বাস্তবতায় স্বাস্থ্যের উন্নতি বা স্বাস্থ্যে পরিবর্তন আনতে হলে নাগরিক সক্রিয়তার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে অনেক ভালো রিপোর্ট আছে, ভালো ভালো অনেক পরামর্শ দেওয়া হয়। সেগুলো কেউ পড়েন না, শোনেন না। আসন্ন নির্বাচন শেষ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে নিয়ে একটি মুক্ত আলোচনার আয়োজনের প্রস্তাব দেন তিনি।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, রাজনীতিতে, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এবং সাধারণ মানুষের কাছে স্বাস্থ্যকে আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরার প্রয়াস বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের জন্য আমাদের ছয় দফা হচ্ছে—স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, রোগ প্রতিরোধ ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বারোপ, ওষুধের সহজপ্রাপ্যতা, নগর স্বাস্থ্য, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ও মহামারি মোকাবিলা এবং স্বাস্থ্যপদ্ধতি দৃঢ়করণ।

গোলটেবিল বৈঠকের মূল উপস্থাপনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক এ ছয়টি বিষয়কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সুপারিশ উল্লেখ করেন। রুমানা হক বলেন, ব্যক্তির স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারি অংশ বাড়ছে না, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। ২৬ শতাংশ খানা বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখে পড়ছে। ক্যানসার, যকৃৎ ও পক্ষাঘাতের চিকিৎসা করাতে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের ২৫ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে, ১১ শতাংশ ডায়াবেটিসে, ২৯ শতাংশ অতি ওজনে ভুগছে। ৯৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান না।

বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও প্রথম আলো আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতে আগামী দিনের প্রতিশ্রুতি: একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। প্রথম আলো কার্যালয়, কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর
ছবি: প্রথম আলো

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, পরিবর্তনের জন্য কাজ করার বহু ক্ষেত্র আছে। কিন্তু নানা জটিলতায়, নানা কারণে তা হয় না। তিনি বলেন, অন্তত তিনটি কাজ করা যায় যাতে আর্থিক–সংশ্লিষ্টতা কম। এগুলো হচ্ছে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা, কার্যকর যোগাযোগ ও সমন্বয়। এ তিনটি কাজ কীভাবে হবে তার ব্যাখ্যা ও উদাহরণ দেন তিনি।

ওষুধের ব্যবহার কীভাবে মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয় কমাতে পারে তা যুক্তিসহকারে বর্ণনা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলোজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাঈদুর রহমান। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয়ের দুই–তৃতীয়াংশ যায় ওষুধে। ওষুধের বাজার ৩০ হাজার কোটি টাকার। এর ৭–৮ শতাংশ বহন করে রাষ্ট্র।

রাষ্ট্র যদি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় ২৫০ থেকে ২৮০টি ওষুধ অন্তর্ভুক্ত করে, তা হলে ৯৫ শতাংশ ওষুধের প্রয়োজন মেটে। এই ওষুধ রাষ্ট্র নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে তৈরি করতে পারে। নিজে কিনতেও পারে। রাষ্ট্র ওষুধে ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে ব্যক্তির কাছ থেকে ৩০০ টাকা ব্যয়ের ভার কমে। তিনি বলেন, ব্যক্তি ওষুধ কেনার সময় ওষুধের মান যাচাই করতে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে কেনা হলে, ওষুধের মান যাচাই সম্ভব।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক এ এম জাকির হোসেন বলেন, আইন দেশের ৩২৯টি পৌরসভার কর্তৃপক্ষকে বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু সেবা দেওয়ার ক্ষমতা বা সক্ষমতা তাদের নেই। এসব পৌরসভাকে সহায়তা কে করবে? তিনি আরও বলেন, এসডিজির স্বাস্থ্যের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে চিকিৎসকসহ সাড়ে সাত লাখের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী থাকতে হবে। আছে প্রয়োজনের অনেক কম।

জনপ্রতিনিধিদের স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত কাজে যুক্ত করার পরামর্শ দেন নারীপক্ষের নারীস্বাস্থ্য ও অধিকার কর্মসূচির পরিচালক সামিয়া আফরীন। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের অনেক স্বাস্থ্যকর্মী অনেক নীতিমালা সম্পর্কে জানেন না। আবার চুক্তিতে স্বাক্ষর করে আসার পরও অনেক কর্মকর্তা তা বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখান না।

রাজনৈতিক নেতাদের কাছে স্বাস্থ্যসেবার রাজনৈতিক মূল্য আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ। তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের কাছে শুধু স্বাস্থ্য স্থাপনা তৈরির মূল্য আছে।

নজরদারি ও জবাবদিহির অভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতালগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সেখানে দালাল আছে। অন্যদিকে বিদেশি হাসপাতালের শৃঙ্খল দেশে চলে এসেছে। মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশ যাচ্ছেন হরদম।

আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাজ্যের দাতা সংস্থা এফসিডিওর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা শেহলীনা আহমেদ বলেন, খাতা–কলমে রোগ প্রতিরোধের কথা বলা হলেও বাস্তবে কর্মকাণ্ড কম চোখে পড়ে। স্বাস্থ্যকে এখনো ওষুধের মধ্যে বেঁধে রাখা হয়েছে। লাইফস্টাইল বা জীবনশৈলী পরিবর্তনের কথা বললেও এই খাতে বরাদ্দ কম। তিনি বলেন, সরকার যদি প্রতিটি ওষুধ কোম্পানিকে দিয়ে উচ্চ রক্তচাপের একটি ওষুধ ও একটি ডায়াবেটিসের ওষুধ তৈরি করায়, মানুষ কম মূল্যে ওষুধ পাবেন।

সহজে সম্ভব এমন অর্জন বাংলাদেশ করে ফেলেছে বলে মন্তব্য করেন সুইডেন দূতাবাসের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মুহম্মদ জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশের মানুষের বয়স কাঠামোয় পরিবর্তন এসেছে, নগর ও গ্রামের জনসংখ্যায় পরিবর্তন এসেছে, সংক্রামক রোগ থেকে বোঝা বাড়ছে অসংক্রামক রোগের, পরিসর বাড়ছে ডিজিটাল–পদ্ধতির। অনুদান কমে বাড়ছে ঋণ। এসব বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বড় কোনো ধাক্কা বা পুনর্গঠন ছাড়া স্বাস্থ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সম্ভব না।

মানসিক স্বাস্থ্য, সড়ক দুর্ঘটনা, স্কুল স্বাস্থ্য কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু। তিনি বলেন, মেডিকেল শিক্ষায় অনেক ছাত্রী আসছে; কিন্তু চিকিৎসা পেশা চর্চায় তাদের ততটা দেখা যাচ্ছে না কেন তা তলিয়ে দেখা দরকার।

গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর শেখ মাসুদুল আলম।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।