সংবাদপত্র ও প্রচারসংখ্যা নিয়ে ডিএফপির অবিশ্বাস্য তথ্য

  • দেশে কেবল মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকা আছে ৫৮৪টি। যদিও বেশির ভাগ পত্রিকা নামসর্বস্ব।

  • সরকারি হিসাব বলছে, দেশে পত্রিকার সংখ্যা ও প্রচারসংখ্যা বাড়ছে। যদিও জরিপ বলছে, পাঠক কমছে।

  • প্রচারসংখ্যার ওপর সরকারি বিজ্ঞাপনের দর নির্ভর করে। তাই বাড়িয়ে দেখানোর অভিযোগ।

প্রতীকী ছবি

আপনি দেশের কয়টি পত্রিকার নাম জানেন? ১০, ২০, ৩০টি? সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশে কেবল মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকা আছে ৫৮৪টি। এর মধ্যে ২৮৪টি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।

অবশ্য এসব পত্রিকার বেশির ভাগেরই নাম পাঠকেরা কখনো শোনেননি। বাজারে নামসর্বস্ব এসব পত্রিকা খুঁজে পাওয়াটাও অনেকটা দুঃসাধ্য সাধনের মতো। কারণ, ঢাকার হকাররা বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে বিলি করেন কমবেশি ৫৪টি দৈনিক পত্রিকা। এই ৫৪টির সব কটি আপনি সব সময় পাবেন না। কিছু পত্রিকার দেখা পাওয়া যাবে শুধু নগরের কিছু দেয়ালে।

এ তো গেল পত্রিকার সংখ্যা। ডিএফপির নির্ধারণ করা পত্রিকার প্রচারসংখ্যাও বিস্ময়কর। সরকারি হিসাব বলছে, ১৭ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিন সব মিলিয়ে ১ কোটি ৮৫ লাখ কপির বেশি পত্রিকা ছাপা হচ্ছে! অর্থাৎ প্রতি ৯ জনের বিপরীতে এক কপি পত্রিকা ছাপা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বেশির ভাগ পত্রিকার মিডিয়া তালিকাভুক্তি এবং প্রচারসংখ্যা নির্ধারণে বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এর সঙ্গে জড়িত ডিএফপির কিছু অসাধু কর্মচারী। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপও কাজ করে।

দেশে বাস্তবে এক কপি পত্রিকা একাধিক মানুষ পড়ে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে একটি পত্রিকা ৮-১০ জনও পড়ে থাকেন। এই হিসাবে দেশে ছাপা পত্রিকার মোট পাঠক ১ কোটি ৮৬ লাখ বলে ২০২৩ সালে বহুজাতিক গবেষণা ও জরিপ প্রতিষ্ঠান কান্তার এমআরবি পরিচালিত জরিপে এসেছে।

দেশে প্রকাশিত সংবাদপত্র ও সাময়িকীর মিডিয়া তালিকাভুক্তি, নিরীক্ষা এবং প্রচারসংখ্যা নির্ধারণ করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিএফপি। মিডিয়া তালিকাভুক্তি বলতে সরকারের তালিকাভুক্ত সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃত হওয়া এবং সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থাগুলোর বিজ্ঞাপন প্রচারের যোগ্যতা অর্জন করাকে বোঝায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বেশির ভাগ পত্রিকার মিডিয়া তালিকাভুক্তি এবং প্রচারসংখ্যা নির্ধারণে বড় ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। এর সঙ্গে জড়িত ডিএফপির কিছু অসাধু কর্মচারী। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপও কাজ করে। মূলত সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়া আর রেয়াতি হারে (নির্ধারিত হারের চেয়ে কম হারে কর) শুল্ককর দিয়ে নিউজপ্রিন্ট আমদানি সুবিধার জন্য পত্রিকার প্রচারসংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়। পত্রিকার প্রচারসংখ্যার ওপর সরকারি বিজ্ঞাপনের দর এবং নিউজপ্রিন্টের প্রাপ্যতা নির্ভর করে।

ডিএফপির হিসাবে যেসব বাংলা দৈনিক পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ১ লাখ ৪১ হাজার বা এর চেয়ে বেশি (সর্বোচ্চ ৫ লাখ ২১ হাজার ২১১), সেসব পত্রিকার জন্য সরকারি বিজ্ঞাপনের দর প্রতি কলাম–ইঞ্চি ৯০০ টাকা। প্রচারসংখ্যা কম হলে সরকারি বিজ্ঞাপন দরও কমে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিকের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের সর্বনিম্ন দর প্রতি কলাম-ইঞ্চি ৩৫০ টাকা।

ডিএফপি) তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশে কেবল মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকা আছে ৫৮৪টি। এর মধ্যে ২৮৪টি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়।

সরকারি হিসাব ও বাজারের চিত্র

ডিএফপির গত আগস্টে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ২৮৪টি সংবাদপত্রের ১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৬ হাজার কপি ছাপা হচ্ছে।

ছাপা পত্রিকার বড় অংশই বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকায়। আর ঢাকার মোট জনসংখ্যা এখন ২ কোটি ১০ লাখ। পাঠকের কাছে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার প্রধান মাধ্যম হকার। ঢাকা মহানগর ও এর আশপাশের (সাভার, নবীনগর, সিঙ্গাইর, গাজীপুর, দাউদকান্দি, মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত) এলাকায় সংবাদপত্র বিলি করে থাকে হকারদের দুটি সংগঠন। এর একটি ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি। আরেকটি হলো সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি। সমিতি দুটির নেতারা জানিয়েছেন, এই দুই সমিতির বাইরে আর কেউ ঢাকা মহানগরে সংবাদপত্র বিলি করে না।

ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিয়মিত ৫২টি পত্রিকা বিলি করেন। তাঁরা প্রতিদিন আনুমানিক সাড়ে তিন লাখ কপি পত্রিকা বিলি করেন।

আর হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি সালা উদ্দীন মো. নোমান প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা দৈনিক ৪৪টি পত্রিকার ৭০-৭৫ হাজার কপি বিলি করেন।

এই দুই সমিতি যেসব পত্রিকা বিলি করে, সেটার নির্দিষ্ট তালিকা আছে। তালিকা দুটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি যে ৪৪টি পত্রিকা বিলি করে, ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমিতির তালিকায়ও তার ৪২টি আছে। অর্থাৎ এই দুটি সমিতি ঢাকায় বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে মোট ৫৪টি দৈনিক সংবাদপত্র বিক্রি করে। সব মিলে প্রতিদিন গড়ে সোয়া চার লাখ কপি পত্রিকা বিক্রি হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় প্রথম আলো ও বাংলাদেশ প্রতিদিন। ১০-১৫টি পত্রিকা বাদে অন্যগুলোর বিক্রির সংখ্যা ১০-৫০ কপির মতো।

এর বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় দেয়ালে কিছু পত্রিকা দেখা যায়। আর কিছু পত্রিকা বের হয় সরকারি বিজ্ঞাপন বা ক্রোড়পত্র পেলে। যখন যে প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয়, সে প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারি কিছু দপ্তরে এসব পত্রিকার কপি পৌঁছে দেওয়া হয় নিজেদের উদ্যোগে। আর কিছু পত্রিকা হাতে গোনা কয়েক কপি ছাপা হয়, যেগুলো কিছু নির্দিষ্ট সরকারি দপ্তর এবং যাদের নিয়ে বিশেষ সংবাদ করা হয়, তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই পত্রিকাগুলো ‘দেয়াল পেস্টিং’ পত্রিকা এবং ‘আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা’ হিসেবে পরিচিত।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি যে ৪৪টি পত্রিকা বিলি করে, ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমিতির তালিকায়ও তার ৪২টি আছে। অর্থাৎ এই দুটি সমিতি ঢাকায় বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে মোট ৫৪টি দৈনিক সংবাদপত্র বিক্রি করে। সব মিলে প্রতিদিন গড়ে সোয়া চার লাখ কপি পত্রিকা বিক্রি হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় প্রথম আলো ও বাংলাদেশ প্রতিদিন।

লাখের বেশি ছাপা হয় ৫৭টি পত্রিকা!

ডিএফপির হিসাবে, ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ৫৭টি দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন ১ লাখ বা তার চেয়ে বেশি কপি ছাপা হয়। যদিও এই পত্রিকাগুলোর বেশির ভাগই ঢাকার হকারদের দুই সমিতির তালিকায় নেই। অর্থাৎ এগুলো ঢাকার বাজারে পাওয়া যায় না।

নব চেতনা, আজকের দর্পণ, ভোরের পাতা, আজকের বিজনেস বাংলাদেশ, মুক্ত খবর, আমার বার্তা, সকালের সময়, ঢাকা প্রতিদিন, বাংলাদেশ বুলেটিন, বর্তমান—ডিএফপির নথিতে এই পত্রিকাগুলোরও প্রচারসংখ্যা দেড় লাখের বেশি উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সমাচার, চিত্র, জনবাণী, ভোরের দর্পণ, লাখো কণ্ঠ, বাংলাদেশের আলো, স্বদেশ প্রতিদিন, নিখাদ খবর, আমার সময়, গণমুক্তি, সোনালী বার্তা, সংবাদ সারাবেলা, বাংলাদেশ কণ্ঠ, খবর, শেয়ার বিজকড়চা, সমাজ সংবাদ, আলোর বার্তা, জনতা নামের পত্রিকাগুলোর একেকটির প্রচারসংখ্যা দেখানো হচ্ছে এক লাখ থেকে দেড় লাখের মধ্যে।

হাজারিকা প্রতিদিন, সোনালী খবর, ভোরের আকাশ, স্বাধীন বাংলা, বাংলার নবকণ্ঠ, প্রথম কথা, গণকণ্ঠ, ঢাকা ডায়ালগ, পল্লীবাংলা, ভোরের সংলাপ, দেশবার্তা, আমাদের বাংলা, তরুণ কণ্ঠ, এই বাংলা, ঢাকা টাইমস, স্বাধীন সংবাদ, সকাল বেলা, আজকের সংবাদ, যায়যায়কাল, অগ্রসর, সংবাদ মোহনা—এই পত্রিকাগুলোর প্রতিটির প্রচারসংখ্যা ৮০ থেকে ৯৫ হাজার বলে সরকারি খাতায় উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিএফপির হিসাবে, ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ৫৭টি দৈনিক পত্রিকা প্রতিদিন ১ লাখ বা তার চেয়ে বেশি কপি ছাপা হয়। যদিও এই পত্রিকাগুলোর বেশির ভাগই ঢাকার হকারদের দুই সমিতির তালিকায় নেই। অর্থাৎ এগুলো ঢাকার বাজারে পাওয়া যায় না।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ডিএফপির মহাপরিচালক পদে যোগ দিয়েছেন আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পত্রিকার যে প্রচারসংখ্যা দেখানো হচ্ছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো ‘শর্টলিস্ট’ করে বিজ্ঞাপন দেয়, এই এখতিয়ার তাদের নেই। এই শর্টলিস্টে অন্তর্ভুক্ত হতে প্রচারসংখ্যার অসুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এ ছাড়া এখানে সার্বিকভাবে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। পুরো জায়গায় ধস নেমেছে। এর সামগ্রিক সমাধানের জন্য নীতি সংস্কার করতে হবে।

ডিএফপির দুর্নীতির অভিযোগ দূর করতে নিরীক্ষাসহ সব কাজ ডিজিটাইজড করার চিন্তা করছেন জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, এখন সংস্কারের একটি সুযোগ এসেছে।

শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকের নাম জানেন?

দেশে শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক বলতে মানুষ চেনে দ্য ডেইলি স্টারকে। কিন্তু ডিএফপির তালিকায় প্রচারসংখ্যায় শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি ট্রাইব্যুনাল। এর প্রচারসংখ্যা দেখানো হয়েছে ৪০ হাজার ৫০০ কপি। প্রচারসংখ্যায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রাখা হয়েছে ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি ও দ্য বাংলাদেশ নিউজ।

সরকারি তালিকায় দ্য ডেইলি স্টার–এর স্থান চার নম্বরে। পাঁচে আছে ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস। ছয় নম্বরে আছে ডেইলি সান, দ্য ডেইলি অবজারভার ও ঢাকা ট্রিবিউন।

অবশ্য ডিএফপি বলছে, তাদের নিরীক্ষায় ডেইলি ট্রাইব্যুনাল–এর প্রচারসংখ্যা ১৩ হাজার ৫০০ কপি নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের আদেশে আগের প্রচারসংখ্যা পুনর্বহাল করা হয়েছে। একইভাবে নিরীক্ষায় ডেইলি ইন্ডাস্ট্রির প্রচারসংখ্যা ১৪ হাজার ২০০ ও বাংলাদেশ নিউজ–এর প্রচারসংখ্যা ৬ হাজার নির্ধারণ করা হয়েছিল। তারাও উচ্চ আদালতে রিট করে। আদালতের আদেশে ডেইলি ইন্ডাস্ট্রির প্রচারসংখ্যা ৩৯ হাজার ৯৯৮ এবং বাংলাদেশ নিউজ–এর ৩৯ হাজার পুনর্বহাল করা হয়।

ডিএফপির তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা থেকে ৪৯টি ইংরেজি দৈনিক বের হয়। কিন্তু ঢাকার হকারদের দুটি সমিতির তালিকায় ১৪টি পর্যন্ত ইংরেজি দৈনিকের নাম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এগুলো ঢাকায় কম-বেশি বিক্রি বা বিলি হয়। তবে এই ১৪টির সব কটি নিয়মিত পাওয়া যায় না।

ডিএফপির তালিকায় প্রচারসংখ্যায় শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি ট্রাইব্যুনাল। এর প্রচারসংখ্যা দেখানো হয়েছে ৪০ হাজার ৫০০ কপি। প্রচারসংখ্যায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রাখা হয়েছে ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি ও দ্য বাংলাদেশ নিউজ।

৬ বছরের ব্যবধানে বেড়েছে পত্রিকা ও প্রচারসংখ্যা!

অনলাইনের বর্তমান যুগে ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে বিশ্বজুড়ে। এই আলোচনা চলছে এক দশক ধরে। ছাপা পত্রিকার প্রচার ও বিক্রি কমছে। বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো জাতীয় পত্রিকা অস্ট্রিয়ার উইনার জাইটুংসহ অনেক ছাপা পত্রিকা বন্ধও হয়ে গেছে। এ দেশেও পত্রিকার পাঠক কমছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল মাধ্যমের বর্তমান যুগে সারা বিশ্বেই ছাপা পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কমছে। করোনা মহামারির সময় ছাপা পত্রিকার প্রচারসংখ্যা এক ধাক্কায় অনেক কমে আসে। করোনা–পরবর্তী সময়ে আবার ছাপা পত্রিকার প্রচার বাড়লেও করোনার আগের অবস্থায় যেতে পারেনি। কান্তার এমআরবি পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে পত্রিকার পাঠক ছিল ২ কোটি ৯২ লাখ। ২০২৩ সালে সেটা কমে হয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ।

কিন্তু ডিএফপির তথ্য বলছে পুরো ভিন্ন কথা। ২০১৮ সালে দেশে মিডিয়া তালিকাভুক্ত দৈনিক পত্রিকা ছিল ৫০৪টি। এখন বেড়ে হয়েছে ৫৮৪টি। সরকারি হিসাবে, ২০১৮ সালে ঢাকা থেকে প্রতিদিন ৭৪ লাখ কপি বাংলা দৈনিক পত্রিকা ছাপা হতো, সেটা এখন দেড় কোটির বেশি।

২০১৮ সালের সরকারি হিসাবে প্রচারসংখ্যা ১ লাখ বা তার বেশি ছিল, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এমন বাংলা দৈনিক ছিল ২২টি। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭টি। ২০১৮ সালে ১০টি পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ৫০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে দেখানো হয়েছিল। ২০২৪ সালে এমন পত্রিকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫। অর্থাৎ ২০২০ সালে করোনা মহামারির পর সব পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কমলেও ডিএফপির হিসাবে বেড়েই চলেছে।

কান্তার এমআরবি পরিচালিত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে পত্রিকার পাঠক ছিল ২ কোটি ৯২ লাখ। ২০২৩ সালে সেটা কমে হয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ। কিন্তু ডিএফপির তথ্য বলছে পুরো ভিন্ন কথা।

সরকারি হিসাবে প্রথম আলো ছাড়া প্রথম সারির কোনো দৈনিকের প্রচারসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি। সরকারি হিসাবের প্রচারসংখ্যা কমাতে প্রথম আলোকে নিজ থেকেই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়েছে।

সরকারি হিসাবে ২০১৮ সালের মে মাসে লাখোকণ্ঠ নামের পত্রিকার প্রচারসংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১৮ হাজার ২০০। এখন সেটা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার! এই ছয় বছরের ব্যবধানে ৬ হাজার ১৬০ থেকে প্রচারসংখ্যা ১ লাখ ৮ হাজার ৫০০ হয়ে গেছে গণমুক্তির। নিখাদ খবর পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ৯ হাজার ৫০০ থেকে বেড়ে এখন ১ লাখ ২০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে ঢাকা ডায়ালগ নামের একটি পত্রিকার প্রচারসংখ্যা দেখানো হয় ৬ হাজার ৬০ কপি। এখন দেখানো হচ্ছে ৯০ হাজার! এমন বিস্ময়করভাবে প্রচারসংখ্যা বেড়েছে, নামসর্বস্ব এমন পত্রিকা আরও অনেকগুলো আছে।

ডিএফপির এসব প্রচারসংখ্যা বা পরিসংখ্যান যেন সুজাতা চক্রবর্তীর গাওয়া বিখ্যাত সেই গানেরই প্রতিচ্ছবি। ‘ভুল সবই ভুল। এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা, সে ভুল।...’

হিসাব ভুয়া, সরকারেরও জানা, ব্যবস্থা নেই

সংবাদপত্র ও সাময়িকীর মিডিয়া তালিকাভুক্তি এবং নিরীক্ষা নীতিমালা নামে একটি নীতিমালা রয়েছে। সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলোর নিরীক্ষা, মূল্য পরিশোধিত প্রচারসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপনের হার নির্ধারণ, ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং নিউজপ্রিন্টের চাহিদার প্রত্যয়ন করা এবং তালিকাভুক্ত সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলোর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এই নীতিমালা করা হয়।

এতে সংবাদপত্রের নিরীক্ষার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি উল্লেখ করা আছে। ছাপা সংখ্যা পরীক্ষা করা, পত্রিকা মুদ্রণবাবদ বিল পরিশোধের হিসাব বিবরণী যাচাই, প্রতি মাস শেষে এজেন্টদের নামে দেওয়া বিলের তালিকা, রেকর্ডপত্র পরীক্ষার সময় স্থানীয় এজেন্ট, হকার, গ্রাহক, নগদ বিক্রয়, বিনা মূল্যে বিতরণ, সৌজন্য বিতরণ এবং মফস্‌সলে বিতরণের জন্য সার্কুলেশন খাতা, এজেন্ট খাতা এবং গ্রাহক খাতা নিরীক্ষার জন্য দেখানোর কথা নীতিমালায় বলা আছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অখ্যাত অনেক পত্রিকা কিছু ভুয়া নথি তৈরি করে। নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে পত্রিকার অবাস্তব প্রচারসংখ্যা দেখানো হয় সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য।

ডিএফপি সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মোট ৯৯টি সংবাদপত্রকে ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে এক বছরে সর্বোচ্চ ১১টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালবেলা ও ডেইলি অবজারভার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০টি ক্রোড়পত্র পেয়েছে জনকণ্ঠ।

ক্রোড়পত্র কারা কতটি পেল

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপন এখন কেন্দ্রীয়ভাবে দেওয়া হয় না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরগুলোর বিজ্ঞাপন নিজেরাই দিয়ে থাকে। শুধু বিভিন্ন জাতীয় দিবসে ক্রোড়পত্র দেওয়া হয় ডিএফপি থেকে।

ডিএফপি সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত মোট ৯৯টি সংবাদপত্রকে ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়। এর মধ্যে এক বছরে সর্বোচ্চ ১১টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন, কালবেলা ও ডেইলি অবজারভার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০টি ক্রোড়পত্র পেয়েছে জনকণ্ঠ।

৯টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে ডেইলি পিপলস টাইম, আমাদের নতুন সময় ও দেশ রূপান্তর। ৮টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে সমকাল, ভোরের কাগজ, প্রতিদিনের বাংলাদেশ ও আজকের পত্রিকা। ৭টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে আমাদের সময়, ইত্তেফাক, সংবাদ, আমার সংবাদ, দৈনিক বাংলা, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ঢাকা ট্রিবিউন ও ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস। ৬টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, প্রতিদিনের সংবাদ, ভোরের ডাক, আমার কাগজ ও সোনালী বার্তা। ৫টি করে পেয়েছে আজকের দর্পণ, আজকালের খবর, বণিক বার্তা, প্রভাত, বিজনেস আই ও ডেইলি সান।

সাংবাদিকতা খাতে অনেক পরিবর্তন এলেও ডিএফপির প্রচারসংখ্যার বিষয়টা একই রকম থেকে গেছে। এটা একটা দুর্নীতির ক্ষেত্র। সরকারি বিজ্ঞাপন বরাদ্দের বিষয়টা এটা ধরেই হয়। অখ্যাত অনেক পত্রিকা তালিকার ওপরে থাকে এবং বিজ্ঞাপন বাগিয়ে নেয়।
গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক

গত অর্থবছরে ৪টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে আজকের বিজনেস বাংলাদেশ, মানবকণ্ঠ, ইনকিলাব, আমার বার্তা, যায়যায়দিন, সমাজ সংবাদ, অগ্রসর, পর্যবেক্ষণ, ভোরের আকাশ, দ্য ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ পোস্ট, বাংলাদেশ টুডে ও দ্য গুড মর্নিং। গত অর্থবছরে প্রথম আলো পেয়েছে ৪টি ক্রোড়পত্র। ৩টি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে বাংলাদেশ বুলেটিন, আমাদের অর্থনীতি, সকালের সময়, বর্তমান, খোলা কাগজ, সংবাদ প্রতিদিন, খবর, লাখো কণ্ঠ, বাংলাদেশের আলো, বাংলার নবকণ্ঠ, স্বদেশ প্রতিদিন, নিখাদ খবর, যায়যায়কাল, জাতীয় অর্থনীতি, আমার বাঙলা ও দ্য এশিয়ান এজ।

অন্য পত্রিকাগুলো এক বছরে একটি থেকে দুটি করে ক্রোড়পত্র পেয়েছে। ইংরেজি দৈনিকগুলোর মধ্যে নিউ এজ গত অর্থবছরে কোনো ক্রোড়পত্র পায়নি।

গণমাধ্যম ও চলচ্চিত্র বিশ্লেষক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাংবাদিকতা খাতে অনেক পরিবর্তন এলেও ডিএফপির প্রচারসংখ্যার বিষয়টা একই রকম থেকে গেছে। এটা একটা দুর্নীতির ক্ষেত্র। সরকারি বিজ্ঞাপন বরাদ্দের বিষয়টা এটা ধরেই হয়। অখ্যাত অনেক পত্রিকা তালিকার ওপরে থাকে এবং বিজ্ঞাপন বাগিয়ে নেয়। তিনি বলেন, চারদিকে সংস্কারের দাবি উঠেছে। এই বিষয়টিরও পরিবর্তন হওয়া দরকার।

আগামী পর্ব: আয়কর দেয় ১% সংবাদপত্র