'বাড়িতে পানি, বাঁধে এসেও শান্তি নেই'
আকলিমা বেগমের (৪৫) বাড়ি গাইবান্ধার ভাষারপাড়া গ্রামে। ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের তাঁর বাড়িতে কোমরসমান বন্যার পানি। দুটি চৌকিসহ ঘরের আসবাব পানিতে ভাসছে। গ্রামের কোথাও শুকনা জায়গা নেই। তাই আশ্রয় নিয়েছেন বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরের ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে।
আকলিমা বলেন, ‘ঘরে যেটুকু ধান–চাল ছিল, তা বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। নয় দিন ধরে বাঁধে থাকলেও এক ছটাক চালও পেলাম না। বাঁধে প্রস্রাব-পায়খানার ব্যবস্থা নেই।’ তাঁর ভাষ্য, বাড়িতে কোমর পানি, বাঁধে এসেও শান্তি নেই। আকলিমার মতো বাঁধে আশ্রয় নেওয়া ফুলছড়ি উপজেলার নারী–পুরুষেরা জানালেন তাঁদের দুর্ভোগের কথা।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বাঁধটি রংপুরের কাউনিয়া থেকে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। বাঁধের প্রায় ৯৮ কিলোমিটার গাইবান্ধার সীমানায়। এর মধ্যে ফুলছড়ি উপজেলার প্রায় ৮ কিলোমিটার অংশে সহস্রাধিক বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ফুলছড়ি উপজেলা ছাড়াও সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর ও সাঘাটা উপজেলার কয়েক হাজার মানুষও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।
গতকাল শনিবার সকালে সরেজমিনে বাঁধের ফুলছড়ি অংশ ঘুরে দেখা যায় আশ্রয় নেওয়া মানুষের দুর্ভোগের চিত্র। বাঁধের দুই ধারে নির্মিত একচালা ছাপরা। ছাপরাগুলোর তিন পাশে বেড়া, এক পাশে ফাঁকা। ছাপরার নিচে চৌকি। খোলা আকাশের নিচে রাখা হাঁড়িপাতিল, আসবাব। বাঁধে নেই অগভীর নলকূপ।
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া ফুলছড়ির সৈয়দপুর গ্রামের দিনমজুর আবদুল জলিল, ঘোলদহ গ্রামের কৃষক জিয়াউল হক বলেন, এখনো তাঁরা ত্রাণ পাননি। খেয়ে না–খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গবাদিপশুর খাবারের সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ কে এম ইদ্রিশ আলী বলেন, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গাইবান্ধা সদর উপজেলা, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার ২৬টি ইউনিয়নের ১ লাখ ২২ হাজার ৩২০ জন মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। তাদের জন্য ২০০ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১১ লাখ টাকা ও শিশুখাদ্য হিসেবে আরও ২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন নগদ টাকা দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদকে (ইউপি) শুকনা খাবার কিনে দেবে। পরে চেয়ারম্যানরা এসব শুকনা খাবার বাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানুষসহ বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করবেন।
পায়খানা-প্রস্রাবখানা ও নলকূপ প্রসঙ্গে গাইবান্ধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হোসাইন বলেন, গত শুক্রবার থেকে বাঁধে অস্থায়ী পায়খানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে নলকূপ স্থাপনের। এ ছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণের বড়ি জনপ্রতিনিধির কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এসব বিতরণ করবেন।
>নীলফামারীতে আবার অবনতি।
কুড়িগ্রাম ও সিরাজগঞ্জে নদীর পানি কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপরে
ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সিলেটে উন্নতি
সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঁধে আশ্রয় নেওয়া এক নারী বলেন, সন্ধ্যার পর কিছু বখাটে বাঁধে ঘোরাফেরা করে। তারা মেয়েদের লক্ষ্য করে নানা ধরনের মন্তব্য করে। আর কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের সমিতির বাজার গ্রামের কৃষক সাখাওয়াত মিয়া অভিযোগ করলেন, প্রায়ই বাঁধের ছাপরা থেকে জিনিস চুরি যাচ্ছে। বাঁধে এসেও তাঁরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
এ প্রসঙ্গে ফুলছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাওছার আহম্মেদ বলেন, ব্রহ্মপুত্র বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে টহল আরও জোরদার করা হবে।
এদিকে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদের পানি কমতে শুরু করলেও গতকাল বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৬৬ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদের পানি বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অন্যান্য নদ-নদীগুলোতে পানি কমতে শুরু করেছে।
উন্নতি–অবনতি–অপরিবর্তিত
নীলফামারী জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হয়েছে। গতকাল সকালে লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুপুর ১২টায় পানি ১৭ সেন্টিমিটার কমে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
কুড়িগ্রামে নদ–নদীর পানি ধীরে কমলেও এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। এ ছাড়া দেখা দিয়েছে তীব্র নদীভাঙন। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, গতকাল বেলা তিনটায় ধরলার পানি সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার এবং নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি কিছুটা কমলেও এখনো বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে।
ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সব নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেটের নিম্নাঞ্চল ও কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায় গত ২৮ জুন বন্যা দেখা দেয়। তিন দিন পর ভারী বর্ষণ থামলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে।
সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। জেলার উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত উপজেলাগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে পানি বাড়ছে নিচু এলাকায়।