হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য দিঘি ও পুকুর

কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে চেনাজানা অনেক পুকুর। অনেক এলাকার নামকরণ হয়েছে পুকুর ঘিরে। এখন এলাকা থাকলেও পুকুর নেই।

স্থানীয় বাসিন্দাদের গোসলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে এখনো ব্যবহৃত হয় আগ্রাবাদ ঢেবা। গতকাল বেলা ১১টায় আগ্রাবাদে।জুয়েল শীল

‘চট্টগ্রামের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষ প্রায় সব বাড়ির পেছন দিকে মেয়েদের পুকুর, সামনের দিকে পুরুষদের পুকুর—মোট দুটি করে পুকুর থাকে। বাড়ির পেছনে পুকুর না থাকলে সেকালে ভালো বৈবাহিক সম্পর্ক করা যেত না।’ চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী তাঁর চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা বইতে পুকুরের সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের সম্পর্কের কথা এভাবেই বর্ণনা করেছেন। পুকুর, দিঘি, জলাশয় এসব শুধু সুপেয় পানির উৎস ছিল না, ছিল শৌর্যবীর্যের প্রতীক। এগুলোর স্বচ্ছ জলে মানুষের গৌরবের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত। কিন্তু সেই গৌরব, সেই অহংকার, সেই ঐতিহ্য আজ শুধু দূর অতীতের ইতিহাস।

চট্টগ্রাম শহরে এমন দৃশ্য এখন বিরল। পথ চলতে চলতে চোখকে শীতল করে দেওয়ার মতো জলাশয় এখন আর চোখে পড়বে না। সম্প্রতি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে প্রতিবছর জলাভূমির সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। এ গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এ বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় জলাশয় চিহ্নিতকরণ ও শ্রেণিবিভাগ শিরোনামে এবং ভারতে পাবলিশার্স স্ট্রেঞ্জারসের জার্নাল অব দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব রিমোট সেনসিংয়ের ৪৯ নম্বর ভলিয়ুমে ‘স্পেশোটেম্পর‍্যাল চেঞ্জ অব আরবান ওয়াটার বডিস ইন বাংলাদেশ: আ কেস স্টাডি অব চিটাগাং মেট্রোপলিটন সিটি’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০১৬ ও ’১৭ সালে দুই বছরব্যাপী গবেষণা জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন দুটি তৈরি করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে এবং বাংলাদেশ স্পেস রিসার্চ অ্যান্ড রিমোট সেন্সিং অর্গানাইজেশনের (স্পারসো) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলামের সহযোগিতায় পিএইচডি গবেষক মোরশেদ হোসেন মোল্লা গবেষণার কাজটি করেন। গবেষণার শিরোনাম ছিল ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাভূমির স্থানিক ও কালিক পরিবর্তন’।

চট্টগ্রামের জলাশয় নিয়ে সর্বশেষ এই জরিপের শুরুতে তাঁরা ভূ-উপগ্রহে ধারণ করা চিত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ১ হাজার ৩৫২টি জলাশয় চিহ্নিত করেন। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রামের ৪১টি ওয়ার্ডে সরেজমিন জরিপ চালিয়ে মোট ১ হাজার ২৪৯টি জলাশয়ের সন্ধান পান। এর আগে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য বিভাগের জরিপে চট্টগ্রামে ১৯ হাজার ২৫০টি জলাশয় পাওয়া যায়। ২০০৬ ও ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জরিপে পাওয়া যায় ৪ হাজার ৫২৩টি জলাশয়।

গৌরবের অতীত

একটা সময় ছিল যখন ধনী বিশেষ করে জমিদার, ব্যবসায়ীরা নিজের প্রতিপত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতেন পুকুর বা দিঘি খনন করে। এগুলোর নামকরণ হতো নিজের অথবা বংশের নামে। আজ থেকে ১০০ বছর আগে চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি প্রণীত চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থে চট্টগ্রাম নগর ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তি বা বংশের নামে খনন করা ৩৭৬টি দিঘির কথা উল্লেখ আছে। এসবের বেশির ভাগ এখন অস্তিত্বহীন।

গত কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে চেনাজানা নামকরা অনেক পুকুর। অনেক এলাকার নামকরণ হয়েছে পুকুরকে ঘিরে। এখন এলাকার নাম রয়ে গেছে, কিন্তু পুকুর বা দিঘি নেই। যেমন নন্দনকাননের একটি এলাকার নাম রথের পুকুরপাড়। ঐতিহ্যবাহী পুকুরটা এখন বহুতল ভবনের নিচে হারিয়ে গেছে। তেমনি হারিয়ে গেছে আন্দরকিল্লার রাজা পুকুর, দেওয়ানবাজারের দেওয়ানজি পুকুর, চান্দগাঁওয়ের মৌলভী পুকুর, ফিরিঙ্গীবাজারের ধাম্মো পুকুর, বহদ্দারহাটের মাইল্যার পুকুর, চকবাজারের কমলদহ দিঘি, কাট্টলীর সিডিএ এলাকার পদ্মপুকুর ও উত্তর কাট্টলীর চৌধুরীর দিঘি, ষোলোশহর হামজারবাগ এলাকার হামজা খাঁ দিঘি, খতিবের হাট পুকুর।

বর্তমানে অযত্নে, অবহেলা আর তত্ত্বাবধানের অভাবে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে এনায়েত বাজার এলাকার রানীর দিঘি, আসকার দিঘি, পাহাড়তলীর পদ্মপুকুর, বড় মিয়ার মসজিদ পুকুর, হালিশহরের খাজা দিঘি, চান্দগাঁওয়ের মুন্সি পুকুর, বাকলিয়ার আবদুল্লাহ সওদাগর পুকুর, আশকার দিঘি, আগ্রাবাদ ঢেবার দিঘি, মিনামার দিঘি, কর্নেল দিঘি, কর্নেল হাট দিঘি, হাজারীর দিঘি, কারবালা পুকুর, ভেলুয়া সুন্দরীর দিঘি, কাজীর দিঘি।

কেন কমছে জলাভূমি

জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভূমির মূল্যবৃদ্ধি, নতুন আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা নির্মাণ, পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার অভাবসহ দুর্নীতিই নগরীর জলাভূমির ভরাট বা হ্রাসের উল্লেখযোগ্য কারণ বলে গবেষণায় পাওয়া তথ্যে জানা যায়।

চট্টগ্রাম মহানগর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বলেন, জলাশয় কমে যাওয়ার ফলে নগরে সুপেয় পানির তীব্র সংকট তৈরি হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জলাশয় ভরাট করে যেসব বহুতল ভবন গড়ে উঠছে, সেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এসব ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জলাশয় না থাকায় সবচেয়ে ঝুঁকি থাকে অগ্নিকাণ্ডের সময়। আগুন নেভানোর পানিও পাওয়া যায় না।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভে পানি ঢোকার একটা প্রাকৃতিক পথ হলো জলাশয়। জলাশয় কমে যাওয়ায় ভূগর্ভে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। পরিবেশের জন্য এটা বড় অশনিসংকেত।

করণীয় কী

পরিবেশ আইনে জলাশয় ভরাট করলে পরিবেশ ক্ষতিপূরণে সাজার বিধান আছে। জলাশয় দখল ও ভরাট রুখতে এই আইনের প্রয়োগ ও নীতিমালাকে শক্তিশালী করতে হবে বলে অভিমত দিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, পুকুর ভরাটের সময় ভাগ-বণ্টনের গন্ডগোল না হলে কেউ জানায় না। তারা জানতে পারলে পুকুর ভরাট তাৎক্ষণিক বন্ধ করা যায়। সম্প্রতি বাকলিয়ায় রাহাত্তার পুলের কাছে একটি পুকুর ভরাটের কাজ বন্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মামলাও হয়েছে।

সরকার প্রকল্প হাতে নিয়ে ডিজিটাল সার্ভে করে কতগুলো জলাশয় আছে তা নিশ্চিত করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে।

তবে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য রক্ষায় সবচেয়ে প্রয়োজন হলো এখানকার বাসিন্দাদের আন্তরিকতা ও সচেতনতা।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের নির্বাহী সদস্য দেলোয়ার মজুমদার মনে করেন, আইনের প্রয়োগ ও নীতিমালা শক্তিশালী করতে হবে। নগর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো যেমন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম ওয়াসা, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনকে সমন্বয়ের মাধ্যমে জলাশয় রক্ষার কাজ করতে হবে।