বাংলাদেশে একটিই বন আছে, যে বনে লাখো ‘সুন্দরী’র বসবাস। বনটির নাম সুন্দরবন। করোনাকালেই সুন্দরবন পড়ল আম্পানের তাণ্ডবে। বনটি তাতে দমে যায়নি। বরাবরের মতো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। পাঁচ মাসের বেশি হয়ে এল সুন্দরবনে মানুষের আনাগোনা কম। তাতে বুনো প্রাণীগুলো প্রজননকালটা বেশ ভালোভাবেই পার করল।
শীতকালই সুন্দরবন ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময়। গরমে বেশি মানুষ সেখানে যায় না। বন্য প্রাণী সংরক্ষণের কাজে কয়েক বছর ধরে বর্ষায় সেখানে যেতে হচ্ছে।
বর্ষায় সুন্দরবন একদম অন্য রকম। ভ্যাপসা গরম, কিন্তু চারদিকে সবুজের বন্যা। বৃষ্টি নামলে তো কথাই নেই। বনে প্রাণীদের এ সময়ে দেখা পাওয়া দুরূহ। বাঘ তো দূরের কথা, বনের হরিণও নয়। তবে চোখে পড়ে কয়েক জাতের মাছরাঙা। এরাই সুন্দরবনের আসল সুন্দরী।
সুন্দরবনে গেলে ছোট খালগুলোতে সহজেই দেখা মেলে আগুনরাঙা এক মাছশিকারি পাখির। নাম খয়রাপাখ মাছরাঙা। ইংরেজি নাম ব্রাউন-উইংড কিংফিশার। খালের ওপর ঝুলে পড়া ডালে বসে থাকে মাছের আশায়। জোয়ার বা ভাটা সব সময়ই এদের দেখা মেলে। মানুষ বা প্রাণী দেখলে ‘কাক-কাকাকা’ চিৎকার দিয়ে উড়ে যায়। লাল ছুরির মতো চঞ্চু তাক করে পানির দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে। এরপর হঠাৎ ঝপাৎ করে পানিতে লাফ।
দেশে মাছরাঙা মোট ১২ জাতের। বেশির ভাগই দেখা যাবে সুন্দরবনে। আমার কাছে মনে হয়, সুন্দরবন মাছরাঙাদের শহর। খয়রাপাখ মাছরাঙা সুন্দরবনে ভালোই টিকে আছে। সুন্দরবন থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত উপকূলীয় প্যারাবনেই শুধু এরা টিকে আছে। সুন্দরবনেই সম্ভবত পৃথিবীর অধিকাংশ খয়রাপাখ মাছরাঙার বাস। সুন্দরবনেই এরা সুলভ, কিন্তু পাখিটিকে আসলে বিশ্বে ‘প্রায়-বিপন্ন’ বলে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশে একসময় একে সংকটাপন্ন পাখির তালিকায় রাখা হয়েছিল। ২০১৫ সালে আইইউসিএনের সর্বশেষ প্রকাশিত লাল তালিকায় এটি বিপদমুক্ত বলে গণ্য।
সুন্দরবনের সেরা আকর্ষণ লাল মাছরাঙা। আমার প্রিয় মাছরাঙা। সুন্দরবন ছাড়া এই প্রজাতির মাছরাঙা দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। পালকের অনুপম লাল রঙের কারণে ইংরেজিতে এর নাম রাডি কিংফিশার। অনেক দেশের প্যারাবন ও চিরসবুজ বনে পাখিটিকে সুলভ ও বিপদমুক্ত গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে একসময় একে সংকটাপন্ন পাখির তালিকায় রাখা হয়েছিল। ২০১৫ সালে আইইউসিএনের সর্বশেষ প্রকাশিত লাল তালিকায় এটি বিপদমুক্ত বলে গণ্য। গবেষকদের ধারণা, সুন্দরবনে এরা সংখ্যায় কিছুটা বেড়েছে। লাল মাছরাঙা দেখার জন্য আগে সুন্দরবনের গভীরে যেতে হতো, এখন করমজল গেলেও দেখা মেলে।
লাল মাছরাঙার প্রধান খাদ্য কাঁকড়া। তাই অন্য মাছরাঙার সঙ্গে এদের তেমন প্রতিযোগিতা নেই। সুন্দরবনে কাঁকড়া বেশুমার। ভাটা নামার সঙ্গে সঙ্গে লাল মাছরাঙার তৎপরতা তাই অনেক বেড়ে যায়। ভাটায় আটকে পড়া কাঁকড়া ধরে খাওয়া যায় খুব সহজে।
মাছরাঙা সুন্দরবনের বড় উপকরণ। পানিতে মাছের ভারসাম্য রক্ষায় পাখিটি বড় ভূমিকা রাখে। রোগাক্রান্ত ছোট মাছ খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে রোগের প্রাদুর্ভাব কমায়। সুন্দরবনসহ দেশের বিভিন্ন খালবিলে বিষ দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। এতে ছোট মাছ নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছরাঙাদের ওপর।