সুন্দরবনের একটি পাখি নিয়ে সব সময় আলোচনা হয়। যেকোনো পাখি দেখিয়েদের বড় আকর্ষণ হলো, কালামুখ প্যারাপাখি বা সুন্দরী হাঁস। সুন্দরবনে গবেষণার কাজে এখন প্রতিবছরই যেতে হয়। গত বর্ষা মৌসুমে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ থেকে শরণখোলা পর্যন্ত বেশ লম্বা একটা পথ পাড়ি দিলাম পাখিটিকে দেখার আশায়। সে যাত্রায় ছয় দিনে মাত্র একবার প্রিয় এ পাখির দেখা পেলাম। কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ হলো না।
আমাদের সবারই ধারণা, সুন্দরবনে বাঘের চেয়ে বিপন্ন প্রাণী আর একটিও নেই। কিন্তু বাঘের মতোই আরও বিরল প্রাণী সুন্দরবনে আছে বেশ কয়েকটি। এদেরই একটি হলো কালামুখ প্যারাপাখি। ইংরেজিতে বলে মাসকেড ফিনফুট। গবেষকদের ধারণা, গোটা পৃথিবীতে এই জাতের পাখি টিকে আছে মাত্র ৫০০টি। আর এই সংখ্যার সবচেয়ে বড় অংশ আমাদের সুন্দরবনে দেখা যায়। একসময় পাখিটির নিরাপদ আশ্রয়স্থল সুন্দরবন হলেও প্রতিবছরই আশঙ্কাজনক হারে এর সংখ্যা কমছে।
এমনই এক সংকটময় অবস্থায় পাখি গবেষক বন্ধু সায়েম ইউ চৌধুরীর নেতৃত্বে সুন্দরবন এলাকায় এই পাখির ওপর গবেষণা শুরু হয় ২০১১ সালে। সুন্দরবনের বড় একটা অংশজুড়ে চলে এর শুমারি। পাখিটির প্রজননপ্রক্রিয়া কীভাবে চলে এবং পাখিগুলো এখানে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, তাও দেখা হয় গবেষণায়।
গবেষণাকালে মোট ২৫টি পাখির বাসার সন্ধান পাওয়া গেল। এর মধ্যে বেশ কিছু বাসা পরিত্যক্ত ছিল। দুটি বাসায় দুই জোড়া পাখির প্রজননপ্রক্রিয়া গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলো। জায়গাটা ছিল চিটা-কটকা এলাকার একটা সরু খালের ভেতর।
কিন্তু এই গহিন খালের ভেতর বসে থেকে তার প্রজননপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা খুবই দুরূহ। তাই বন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে কাজগুলো করা হলো।
দীর্ঘ ২৩ দিন এই প্রক্রিয়ায় কালামুখ প্যারাপাখির বাসা ও পাখিগুলোর গতিবিধির ওপর নজর রাখা হয়। ডিম দেওয়ার ১০ দিন পর পুরুষ পাখিটি স্ত্রী পাখিটিকে রেখে চলে যায়। সে আর কখনো ফিরে আসেনি। এই প্রজাতির পাখিটির এ ধরনের স্বভাব গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তারপর মেয়ে পাখিটি একাই ডিম তা দিয়ে বাচ্চা ফুটায়।
ঠিক পরের বছরের গবেষণায় আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এল। একটি বাসায় ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার ঠিক আগ মুহূর্তে একটি ইগল সব কটি ডিম খেয়ে ফেলল। মা পাখিটি বাসার পাশে বেশ কয়েক দিন কাটিয়ে বিদায় নিল ওই এলাকা থেকে।
সারা পৃথিবীতে কালামুখ প্যারাপাখির আবাসস্থল সংকটই তার হারিয়ে যাওয়ায় প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। আমাদের সুন্দরবনে মূল সমস্যা হলো, জেলেদের অপরিকল্পিত মাছ ধরা। চারপাতা জাল দিয়ে জেলেরা মাছ ধরার সময় এদের বাসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষক দল ১০০ জন জেলের ওপর পাখিটি নিয়ে জেলেদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এঁদের প্রত্যেকেই বলেছেন, জীবনে অন্তত একবার কালামুখ প্যারাপাখি শিকার করে এর মাংস খেয়েছেন। বেশির ভাগ জেলেই বলেছেন, চারপাতা জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় এই পাখির বাসা তাঁরা খুঁজে পান। তারপর রাতের আঁধারে ডিমে তা দেওয়া পাখিকে তার বাসা থেকে শিকার করেন।
গহিন সুন্দরবনে জোয়ার-ভাটা পাখিটির জীবনে বড় প্রভাব আছে। পাখিটি ভাটার সময় খালের পাড়ে খাবার খোঁজে। ছোট মাছ, চিংড়ি, কীটপতঙ্গ আর কাঁকড়া এদের প্রধান খাবার। সুন্দরবনের জলে লবণাক্ততার প্রভাব পড়লে বেঁচে থাকায় প্রভাব পড়তে পারে বলে গবেষকেরা ধারণা করছেন।
সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ, ডলফিন কিংবা কুমিরের চেয়ে কোনো অংশে এই পাখিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বাদাবনে টিকে থাকতে পারে বলে পাখিটি অন্য সব পাখির চেয়ে আলাদা।
দেখতে হাঁসের মতো হলেও কালামুখ প্যারাপাখি কিন্তু হাঁস পরিবারের নয়। হলদেটে লম্বা ঠোঁট আর সবুজাভ পা দেখে অনেকে একে সুন্দরী হাঁস বলে দাবি করেন।
বাংলাদেশ ছাড়া এ পাখি এখন মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ায় কিছু সংখ্যক টিকে আছে। বিপন্ন এই পাখিকে বাঁচাতে সুন্দরবনের সুপতি থেকে চিটা-কটকা পর্যন্ত একটা অভয়ারণ্য গড়ে তোলা দরকার। চারপাতা জালমুক্ত এ অঞ্চল গড়ে তুলতে পারলেই পাখিটি বড় আবাসস্থল হবে আমাদের সুন্দরবন।