সিআরবি এলাকায় ১৮৩টি ঔষধি গাছের সন্ধান: গবেষণা
চট্টগ্রাম নগরের ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত সবুজ পাহাড়ি এলাকা সিআরবির বনজঙ্গলে ১৮৩টি ঔষধি গাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো ক্যানসার, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্ডিস, অর্শসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিআরবি এলাকাটি নিজেই যেন একটি ‘প্রাকৃতিক হাসপাতাল’। এখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে এসব ঔষধি গাছের বেশির ভাগ ধ্বংস হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেলের নেতৃত্বে বেসরকারি সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইকো) গবেষণাটি করে। চট্টগ্রাম নগরের ২০টি এলাকার গাছের ওপর চার মাসের বেশি সময় ধরে গবেষণাটি করা হয়। গবেষণার অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের ‘ফুসফুস’খ্যাত সিআরবি রয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার গবেষণার ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।
জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, ‘সিআরবি এলাকাটি নিজেই যেন একটি প্রাকৃতিক হাসপাতাল। এখানে আমরা ১৮৩টি ঔষধি গাছের সন্ধান পেয়েছি। এসব গাছ বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বনৌষধির পাশাপাশি মেডিকেল সায়েন্সের ওষুধের জন্যও এসব উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয়। আমাদের উচিত এই গাছগুলো সংরক্ষণ করা।’
গবেষণায় সিআরবি এলাকায় মোট ২২৩ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া যায়। তার মধ্যে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ ৩৪ প্রজাতির। লতাজাতীয় উদ্ভিদ ২২ প্রজাতির। বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ৯টি। ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে—এ রকম উদ্ভিদ ৬৬টি। এলাকাটিতে বড় বৃক্ষ রয়েছে ৮৮টি। যার মধ্যে শতবর্ষী গর্জন ও শিরীষ আছে।
গবেষণায় সিআরবির চেয়ে নগরের বাটালি পাহাড় ও মুরগির ফার্ম এলাকায় মাত্র দুই থেকে সাতটি ঔষধি গাছ পাওয়া গেছে। গাছের সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে সিআরবি নগরের ২০টি এলাকার মধ্যে তৃতীয়।
গবেষণার উদ্যোক্তা ইকোর সভাপতি সরওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর ক্রমেই বনজঙ্গলশূন্য হয়ে পড়ছে। এই উদ্বেগ থেকে বর্তমানে এখানে কী পরিমাণ সবুজ অবশিষ্ট রয়েছে, তা অনুসন্ধানের জন্য আমরা গবেষণাকর্মটির উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমাদের গবেষকেরা অনেক ঔষধি গাছের সন্ধান পেয়েছেন।’
গবেষকেরা জানান, সিআরবি এলাকায় যেসব ঔষধি গাছ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে টোনা (Oroxylum indicum), অর্জুন (Terminamia arjuna), লজ্জাবতী (Mimosa pudica), আপাং (Achyranthus aspera), নিসিন্দা (Vitex nikundu), টগর (Tabernaemontana divericata), শজনে (Moringa oliefera), দেবকাঞ্চন (Bauhinia purpuria), মাটমিন্দা (Tacca intigrifolia), সর্পগন্ধা (Rauvolfia tetraphylla), বকুল (Mimusops elengi), শিমুল (Bombax ceiba), পিতরাজ (Aphanamixis polystachya), দুধকুরুস (Wrightia arborea), বাকা গুলঞ্ছ (Tinospora erispa), সোনাতলা (Diploclasia glaucescens), দুরন্ত (Duranta erecta) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
গবেষকেরা জানান, টোনা ক্যানসার রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জন্ডিস, শরীরব্যথা, পেটব্যথা, ডায়ারিয়া, আমাশয়, বাত, শ্বেতী ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায়ও এ গাছ ব্যবহৃত হয়।
অর্জুন ডায়ারিয়া, আমাশয়, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, দাঁতব্যথা, শরীরব্যথা, হাঁপানি ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় এই গাছ ব্যবহৃত হয়।
লজ্জাবতীর মূল, কাণ্ড, পাতা, ফুল—সবকিছুরই ভেষজ গুণাগুণ রয়েছে। ফোলা, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, অর্শ, কফ-কাশি, ফোড়া, জন্ডিস ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় লজ্জাবতী ব্যবহৃত হয়।
নিসিন্দাপাতা নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে দাদ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
লজ্জাবতী, নিসিন্দা, সর্পগন্ধা সাপের বিষ নিষ্ক্রিয়করণে ব্যবহার করা হয়।
আপাংয়ের শিকড় ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। লিউকোরিয়া, টিউমার, দাঁতব্যথা, কিডনিতে পাথর, ঠান্ডা, জ্বর, নিউমোনিয়া, পেটব্যথার চিকিৎসায় আপাংয়ের ব্যবহার রয়েছে।
টগর জন্ডিস, ফোঁড়া, জ্বর, বদহজম, প্লীহা, লিভারের রোগ, বাত ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
শজনের শিকড়, কাণ্ড, পাতা, ফুল ও ফল দারুণ পুষ্টিসমৃদ্ধ। এ জন্য একে ‘ম্যাজিক’ গাছ বলা হয়। এর রয়েছে নানাবিধ ভেষজ গুণাগুণ। প্লীহা ও লিভারের রোগ, জ্বর, ফোলা, পক্ষাঘাত, পেটের রোগ, মৃগীরোগের চিকিৎসায় এটি ব্যবহার করা হয়।
দেবকাঞ্চন রক্তক্ষরণ বন্ধ, বাত, খিঁচুনি, ডায়ারিয়া, ব্যথা, আলসার ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতেও দেবকাঞ্চনের ব্যবহার রয়েছে।
মাটমিন্দাপাতা রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ব্যবহার করা হয়।
গবেষকেরা জানান, সিআরবি এলাকায় ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে—এমন উদ্ভিদগুলোর মধ্যে রয়েছে সর্পগন্ধা, বকুল, শিমুল, পিতরাজ, দুধকুরুস, বাকা গুলঞ্ছ, সোনাতলা, দুরন্ত ইত্যাদি।
গবেষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থী মো. খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, সজীব রুদ্র, মো. আরিফ হোসাইন, সনাতন চন্দ্র বর্মণ, ইকরামুল হাসান ও মো. মোস্তাকিম অংশ নেন।
ইকোর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম ইউসুফ সোহেল ও সাহেদ মুরাদ বলেন, সিআরবিতে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঔষধিগুণসমৃদ্ধ বৃক্ষ রয়েছে, তা তাঁরা আগে জানতেন না। এগুলো দেশের সম্পদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সবুজ রক্ষা করা সবার দায়িত্ব।
সিআরবি এলাকা থেকে প্রস্তাবিত হাসপাতালটি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে এখানকার ‘প্রাকৃতিক হাসপাতাল’ রক্ষার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞসহ পরিবেশকর্মীরা।
সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করে এক মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে আসছে বিভিন্ন সংগঠন। তাদের দাবি, সিআরবির শান্ত-কোলাহলহীন সবুজ এলাকা বাদ দিয়ে হাসপাতালটি শহরের অন্য কোথাও করা হোক।
আন্দোলনরত সংগঠন নাগরিক সমাজের উদ্যোক্তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সিআরবি ঐতিহ্যগতভাবে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি বৃক্ষরাজিতেও অনন্য। বৃক্ষরাজির দিকটি গবেষণায় উঠে এসেছে। নগরজীবনে এত ঔষধি গাছ কোথায় পাব আমরা?’
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ আবদুর রবসহ সাতজনে কবর রয়েছে সিআরবি এলাকায়। পিপলস ভয়েস নামের একটি সামাজিক সংগঠন সিআরবির শতবর্ষী গাছগুলোয় শহীদদের নামফলক টাঙিয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, ‘এখানে বীর শহীদরা শুয়ে আছেন। এই গাছ ও সবুজ এলাকা রক্ষা করা হলে তাঁদের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করা হবে।’
ব্রিটিশ আমলে তৈরি সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং এখানে অবস্থিত। এখানকার ছয় একর জমিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য রেলওয়ে চুক্তি করেছে।