সন্তানের ছবি দেখেন না এই মায়েরা
গাজীপুরের টঙ্গীর ভাড়া বাড়ির মাপা বারান্দার বদলে বড় উঠান পেয়ে আহ্লাদ হয়েছিল অপু-নিপুর। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের অপু-দুর্গার মতোই বয়সের ব্যবধান দুই ভাইবোনের। নতুন উঠানের কাঁচা মাটি খুঁড়ে ঘরবাড়ি বানায় তারা। সেখানে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মাটিতে লিখে রাখে নিজেদের নাম। কারও হাঁটাপথে মুছে গেলে মন খারাপ হয়।
বাগেরহাটের শরণখোলার খুড়িয়াখালী গ্রামের এই বাড়ির বয়স তখন মোটে দেড় বছর। ১১ বছরের নিপুকে তখন টঙ্গী থেকে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে সুন্দরবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। শহরে বড় হওয়ায় সাঁতার শেখা হয়নি ওর। সেদিন দুপুর থেকেই আকাশের ঢক্কানিনাদ অবিরাম। বিকেল থেকে জোর বাতাস। উপকূলের মানুষ হিসেবে ওদের মা রানী বেগমের মনে হয়েছিল, উন্মাদ বাতাস নদীর মতোই বেপরোয়া এখন। বাতাসের গতিক ভালো না টের পেয়েই চেয়েছিলেন উঁচু কোথাও আশ্রয় নিতে। গোটা উপকূল তখন আকাশের অন্ধকার আর জোয়ারের স্রোতের বন্ধনীতে আটকা পড়েছে। ঘর থেকে বের হতেই নিভে গেল নিপুর হাতে থাকা হারিকেনটি।
নিপুর শেষ আকুতি ছিল, ‘মা আমার হাত ছাইড় না।’ সন্তানকে আশ্বস্ত করেছিলেন রানী বেগম। অন্ধকারের সুযোগে উঠানে আসা বলেশ্বর আর ভোলা নদের পানির মাপ তখন উপকূলের নারীর কাছেও অজানা।
তেড়ে আসা অন্ধকার মেশানো বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে নদীর পানি। ঘরের সিঁড়ি থেকে দু’পা বাড়াতেই বুক পর্যন্ত ডুবে গেলেন সন্তানসহ রানী বেগম। পরের ঢেউটাই এল রাক্ষুসে দানবের মতো। রানীর ভাষায়, একটা বড় পানির ঘূর্ণি। সেই ঘূর্ণিতে অপুকে কোলে নিয়ে পড়ে গেলেন তিনি। সন্তানসহ ডুবে যাচ্ছেন মা, মেয়েকে টেনে নিচ্ছে পানির গতি। অন্ধকারের মধ্যে মনে রাখা, না রাখার মতো একবার আবছা দেখলেন সে দৃশ্য।
গর্তটা সম্ভবত বাড়ির পাশের নিচু জায়গার নরম মাটিতে পানির আঘাতে তৈরি। একমুখী স্রোতে বিচ্ছিন্ন হওয়া নিপুও সেখানেই পড়েছিল। হাবুডুবু খেতে খেতে এক হাতে সাঁতার কাটতে চেষ্টা করছেন রানী। অন্ধকার সেই গহ্বর থেকে সাঁতরে ওঠার সময় একবার পায়ের সঙ্গে স্পর্শ পেয়েছিল নিপুর। সেই শেষ স্পর্শ মা-সন্তানের। বাতাস, পানি আর অন্ধকারের ভেতর রানী বেগমের আর কিছু মনে নেই। শুধু জানেন জ্ঞান হারানোর আগপর্যন্ত ছেলের হাত শক্ত করে ধরে তিনি শুধু সাঁতারই কেটেছেন।
বাতাসে এসে থামিয়ে দেয়, অন্ধকার কোনো দিকের নিশানা রাখে না, স্রোতে টেনে নেয় তবুও শুধু পানি কেটে কেটে আগায় সে। পায়ে সামান্য ভাঙার মতো ঠেকলেই জ্ঞান হারিয়েছিলেন। চোখ খুলে দেখেছেন, শুয়ে আছেন গ্রামের মসজিদের একটু উঁচু জমিতে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষেরা ভিড় করেছে পাশে।
ছোট অপু মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে ছিল তখন চোখ বন্ধ করে। রানী বেগম তখনো বুঝতে পারেননি, সাঁতরে আসার পথেই মারা গিয়েছে ছোট্ট অপু। আর নিপুর মরদেহ পাওয়া যায় ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের ৪ দিন পর একই গ্রামের ধানখেতে। ছোট শরীরটা নিয়ে যেন কাদাপানির রাজ্যে অভিমান নিয়ে মুখ গুজে শুয়ে ছিল রানীর রাজকন্যা নিপু।
অপুর মরদেহ দাফন করা হলো ভেসে যাওয়া বাড়ির একপাশে সামান্য জল কাদায় উজিয়ে থাকা সাড়ে তিন হাত জায়গায়। নিপুর মরদেহ পাওয়ার পর তুলে এনে ওকেও দাফন করা হলো ভাইয়ের কবরের সঙ্গেই। বাক্হীন হয়ে গেলেন রানী। প্রায় দেড় বছর পর একটু একটু করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা শুরু।
প্রথমেই খুঁজলেন দুই সন্তানের ছবি। ছবি কোথায় থাকবে, ঘরের কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি বলেশ্বর-ভোলা নদ। তবুও মায়ের ইচ্ছা করে সন্তানের মুখটা একবার দেখতে। রানী বেগমের কাছে আমরাও ছবি চেয়েছিলাম। প্রথমে জানিয়েছেন নেই। বহুবার অনুরোধের পর বের করলেন মৃত দুই সন্তানের দুটো ছবি। বললেন, ছেলের একটা ছবিই ছিল তাঁর ভাইয়ের কাছে। সেখান থেকে ওর অংশটুকু কেটে আলাদা করে রেখেছেন। মেয়ের ছবিটা আনা হয়েছে বিদ্যালয়ের পুরোনো ফাইল থেকে। এই ছবি দিয়ে সুন্দরবন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ১১ বছরের নিপু। এই দুটি ছবি রানী বেগমের কাছে তাঁর মৃত দুই সন্তানের অস্তিত্ব। তবে তিনি ছবির দিকে তাকান না। সংবাদে প্রকাশ করতে চাই জেনে প্রথমে নিরুত্তর ছিলেন। দীর্ঘ বিরতি নিয়ে জানালেন ‘মা হয়েও সন্তানদের বাঁচাতে পারি নাই। ২০০৭ সালে আবহাওয়ার পূর্বাভাস সহজে পাওয়া যেত না। ঠিক আছে কেউ যদি অপু-নিপুর কথা শুনে দোয়া করে আমার বাচ্চাদের একটু শান্তি হবে। প্রকাশ করেন, তবে আমি দেখি না এ ছবি। তাকালে মাথার মধ্যে শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দ হয়। তারপর মনে হয় পানিতে ডুবে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। সিডরের ১৪ বছর পরও প্রতি রাতে একই রকম লাগে।’
ভুলতে চাই কিন্তু কিছুই ভুলতে পারি না। চল্লিশ বছর পরও আমার কাছে প্রতিদিনই সেই সিডরের রাত হয়ে থাকবে। যে মা তাঁর চার সন্তানের সবার মৃত্যু চোখের সামনে দেখে, তাঁর জীবনে সেই ঝড়ের রাত কোনো দিন মুছতে পারে?
উপকূলীয় অঞ্চল শরণখোলার সাউথখালীর বকুলতলায় এমন অনেক পরিবার আছে, যাদের কাছে এখনো প্রতিটি দিনই ঘূর্ণিঝড়। তাদের একটি রুহুল ফকিরের সংসার। যাদের চার সন্তানের সবার পরিণতি একই রকম। সেদিন সন্ধ্যায় বাতাসের বেগ বাড়লে ভয় পেয়েছিলেন মাসুমা বেগম। জঙ্গল করা (সুন্দরবন নির্ভর বনজীবী) স্বামী রুহুল ফকির সেই সকালে খুলনা গিয়েছেন কাঠ বেচতে। ঝড়ের পূর্বাভাস পাননি মাসুমা। বাতাস শুরু হতেই চার সন্তান আর ননদকে সঙ্গে করে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। ঘর থেকে বের হয়েই বুঝলেন, বাড়ি তলিয়েছে জলোচ্ছ্বাসে। উঠানের পশ্চিম দিকে একটা কড়ই গাছ আছে। বড় দুই মেয়ে ১১ বছরের রুমি আর ৮ বছরের সুনুকে দাওয়ায় বসিয়ে দিয়ে ৫ বছরের ছেলে মামুনকে ননদের সঙ্গে বসিয়ে দিলেন গাছের এক ডালে। এক বছরের মেয়ে সুমাইয়াকে বেঁধে নিলেন কাপড় দিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে। তারপর আবার ছুটে এলেন ঘরের দাওয়ার কাছে দুই সন্তানকে নিতে। ওদেরও গাছের ডালে বসিয়ে রাখা গেলে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে।
এতটুকু উঠানে আর কতটুকু দূরত্ব! সেই কয়েক ফুটের দূরত্বই তখন যোজন যোজন মাইলের ব্যবধান হয়ে গেল। পানির বেগে এগোতে পারেন না, অথচ ওই তো বসে আছে দুই সন্তান ভয়ে কুঁকড়ে। সেই কয়েক ফুট দূরত্বই আজীবনের ক্ষত হয়ে গেল মাসুমার জন্য। বুকের সঙ্গে তখনো বাঁধা সুমাইয়া। অন্ধকারে আন্দাজ করে ওই সামান্য কয়েক পা আসতে আসতেই যেন বঙ্গোপসাগরের সমস্ত পানি তেড়ে এসে ভাসিয়ে দিল উপকূলের ছোট উঠানটা।
চোখের সামনে ভাসতে ভাসতে বিন্দু হয়ে গেল রুমী আর সুনু। শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠেছিল ‘মা বাঁচাও’ বলে। স্রোতের তোড় ছিটকে কোথায় নিয়ে গেল মাসুমা বেগমকে তিনি জানে না। শুধু বুঝলেন সাঁতরাতে হবে। বুকের কাছ থেকে কেঁদে উঠল সন্তান। তিনি সাঁতার কাটলেন অনির্দিষ্ট অন্ধকারে গতিহীন পথে। কোথাও আলোর এতটুকু দেখা নেই। কখনো গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা লাগে, কখনো ভাসতে থাকা টিনে শরীর কাটে। হাবুডুবু খাচ্ছে সুমাইয়া মায়ের সঙ্গে।
রুমী আর সুনুর ভেসে যাওয়ার দৃশ্য, সামনের অনিশ্চিত অন্ধকার, অনিরাপদ গাছে বসিয়ে রাখা ৫ বছরের মামুনের কথা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল মাসুমা বেগমের মাথার ভেতর। কতক্ষণ পর কোনো শুকনা জায়গায় ঠাঁই পেয়েছিলেন মনে করতে পারেন না। কারা যেন ধরাধরি করে তাঁকে উঁচু জায়গায় টেনে তুলেছিল। মাটিতে শুইয়ে দিয়ে বাঁধন আলগা করে নামিয়েছিল সুমাইয়াকে। ততক্ষণে সুমাইয়া মৃত।
ফুফুর সঙ্গে গাছের ডালে মামুন বসেছিল ঠিকই। কিন্তু ছোট শরীর বেশিক্ষণ সে ভার নিতে পারেনি। ফুফুর হাত ফসকে পড়ে পানির টানে ভেসে গিয়েছিল মামুন। সিডরের দুই মাস আগে তাদের বাবা রুহুল ফকির খুব শখ করে বলেছিলেন, ছেলেমেয়েদের তুলে রাখা ভালো কাপড়-জামা পরাও। হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন তাফালবাড়ির এক স্টুডিওতে। তিন সন্তানকে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে তা প্রিন্ট করে এনে ঘরে রেখেছিলেন যত্ন করে।
ওদের মামা আবার সেই ছবি দেখাতে নিয়েছিলেন বাড়ির অন্য মানুষদের। ঘূর্ণিঝড় সিডরে রুহুল ফকির আর মাসুমা দম্পতির যত্নের চার সন্তান, যত্নের ঘর সব ভেসে গিয়েছে। মাসুমার বাবার বাড়িতে টিনের চালের ভেতর দিকে বেঁধে রাখা কাগজপত্রর সঙ্গে ছিল রুমী, সুনু আর মামুনের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তোলা স্টুডিওর সেই ছবিটা।
১৪ বছরের ঝড়, বন্যা, খরতাপে তা মলিন হয়েছে পুরোপুরি। তবুও বোঝা যায়, সেই ছবিতে লেগে আছে উপকূলের এক দরিদ্র পরিবারের মা–বাবার সবটুকু ভালোবাসা। মাসুমা বেগমের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এক যুগেরও বেশি সময় অতিক্রম হয়েছে। সব মনে আছে আপনার? বললেন, ‘ভুলতে চাই কিন্তু কিছুই ভুলতে পারি না। চল্লিশ বছর পরও আমার কাছে প্রতিদিনই সেই সিডরের রাত হয়ে থাকবে। যে মা তাঁর চার সন্তানের সবার মৃত্যু চোখের সামনে দেখে, তাঁর জীবনে সেই ঝড়ের রাত কোনো দিন মুছতে পারে?’
ঘূর্ণিঝড় সিডরে সাউথখালীর বকুলতলা গ্রামের ২৬ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তার মধ্যে চারজনই রুহুল ফকিরের সন্তান। শরণখোলার খুড়িয়াখালীর রানী বেগম ১৪ বছর পরও রাতে ঘুমাতে পারেন না। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পান স্রোতে ভাসছে নিপু। আর তাঁর কানের কাছে এসে মেয়ে বারবার বলছে, ‘হাত ছাইড় না মা’। স্বপ্নের মধ্যে তিনি সন্তানের হাত ধরতে চান। সে হাত সরে যায় অনেক দূরে। উঠানে কাঁচা হাতে লেখা অপু-নিপু অক্ষরগুলো মুছে দিয়ে যায় বলেশ্বর থেকে উঠে আসা দানবের মতো পানি।