শ্যামপুরের ডাইং বর্জ্য বুড়িগঙ্গায়, পানিতে ক্ষতিকর পদার্থ

শ্যামপুরের পানিতে উচ্চ মাত্রার তেল, গ্রিজ, ফেনল ও অ্যামোনিয়া পাওয়া গেছে
ছবি: আহমেদ দীপ্ত

রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামপুর অংশের পানিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, শ্যামপুরের ডাইং শিল্পের তরল বর্জ্য মিশে নদীর পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। এসব কারখানার বেশির ভাগের বর্জ্য শোধনাগার নেই। তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়ছে। এ দূষণে শ্যামপুরের পানিতে উচ্চ মাত্রার তেল, গ্রিজ, ফেনল ও অ্যামোনিয়া পাওয়া গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ কেন্দ্র (ক্যাপস) ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম একটি গবেষণাটি করেছে। গবেষণার ফলাফল তুলে ধরতে আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর শ্যামপুরের দোলেশ্বর ঘাটে ‘শ্যামপুরের ডাইং ইন্ডাস্ট্রি এবং নদীদূষণ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, শ্যামপুরের পানিতে অক্সিজেনের চাহিদা বেশি, কিন্তু পরিমাণ খুবই কম। এ ছাড়া শ্যামপুরের পানিতে উচ্চ মাত্রার ফেনল, তেল ও গ্রিজের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। পাশাপাশি উচ্চমাত্রার অ্যামোনিয়া পানিতে আছে, যা নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন ক্যাপস প্রধান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। তিনি বলেন, দূষণের হাত থেকে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে ডাইং কারখানার দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। বুড়িগঙ্গা ঢাকার প্রাণ। বুড়িগঙ্গা বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে।

গত বছরে গবেষকেরা বিভিন্ন ঋতুতে শ্যামপুরের পানির গুণমান যাচাই করতে গবেষণা চালায়। এক্সপ্লোরেটোরি স্ট্যাটিস্টিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করে এ গবেষণা হয়। গবেষণার ফলাফলে এসেছে, বুড়িগঙ্গায় পানির অম্লত্বের (পিএইচ) মান বর্ষার আগে-পরে থাকে ৭ দশমিক ৬ থেকে ৮ দশমিক ৫, যা ক্ষারীয়ধর্মী। ডাইং শিল্পের তরল বর্জ্যের কারণে নদীর পানির পিএইচ এমন।।

বুড়িগঙ্গার শ্যামপুর এলাকার পানিতে অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ (টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস, টিএসএস) পাওয়া গেছে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। অথচ পানিতে এর আদর্শ মান ১০
ছবি: আহমেদ দীপ্ত

উচ্চ মাত্রার তেল ও গ্রিজ

যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি), যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) ও কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় গবেষণাটি করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্যামপুরের পানিতে অ্যামোনিয়া ২ থেকে ৪ দশমিক ৮ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যার আদর্শমান শূন্য দশমিক ৫। তিনটি ভিন্ন ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে তেল ও গ্রিজের পরিমাণ ১ দশমিক ৯ থেকে ৫ দশমিক ৬ পর্যন্ত। অথচ এটি শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ থাকার কথা। এসব তেল ও গ্রিজ নদীর পানিকে আলো প্রবেশে বাধা দেয়। নদীর পানিতে ফেনল পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ১৪ থেকে শূন্য দশমিক ২, যার আদর্শমান শূন্য দশমিক ০০২। এই অতিরিক্ত মাত্রার ফেনল পানিকে আরও বিষাক্ত এবং পানের অনুপযোগী করছে। ফেনলের উপস্থিতি ডায়েরিয়া, লিভারে স্থায়ী সমস্যার জন্য দায়ী।

এ ছাড়া বুড়িগঙ্গার শ্যামপুর এলাকার পানিতে অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ (টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস, টিএসএস) পাওয়া গেছে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। অথচ পানিতে এর আদর্শ মান ১০। গবেষকেরা বলছেন, এর মানে সম্পূর্ণরূপে মিশে না যাওয়া কঠিন পদার্থ নদীর পানিতে আস্তরণ তৈরি করছে, যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। পানিতে অক্সিজেন চাহিদার পরীক্ষায় দেখা যায়, রাসায়নিক অক্সিজেনের চাহিদা (সিওডি) ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। অথচ আদর্শমান হচ্ছে ৪। আর জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা (বিওডি) ৮৭, ৭২, ও ১০৬। অথচ আদর্শ মান হিসেবে বিওডি থাকার কথা শূন্য দশমিক ২।

শিল্প এলাকা শ্যামপুরে কারখানার সংখ্যা প্রায় দুই শ। এর মধ্যে ডাইং কারখানা আছে প্রায় এক শ
ছবি: আহমেদ দীপ্ত

শোধনাগার কম, তরল বর্জ্য নদীতে

শিল্প এলাকা শ্যামপুরে কারখানার সংখ্যা প্রায় দুই শ। এর মধ্যে রিরোলিং মিল, ইস্পাত ও তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানা আছে। তবে ডাইং কারখানা আছে প্রায় এক শ। শ্যামপুর–কদমতলী শিল্প মালিক সমিতি জানিয়েছে, এর মধ্যে দশ থেকে ১৫টি কারখানার বর্জ্য শোধনাগার ব্যবস্থা আছে। বাকি কারখানাগুলোর তরল বর্জ্য সরাসরি নালা হয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ে।

শ্যামপুর-কদমতলী শিল্প মালিক সমিতির সদস্য মো. আজিজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এখানকার ডাইং কারখানাগুলোতে বেশির ভাগের বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) নেই। ইটিপি বসাতে সরকার বলেছে। তবে কোনো জায়গা দেয়নি। একটি ইটিপি বসাতে দুই থেকে আড়াই কাঠা জায়গা লাগে। অনেক কারখানায় এই পরিমাণ জায়গাওয় নেই। আজিজুল হকের কথার সত্যতা পাওয়া যায়, শ্যামপুরের ফায়ার সার্ভিস ঘাটে গিয়ে।

সেখানে দেখা যায়, নানা রঙের তরল বর্জ্য বড় একটি নালা দিয়ে বুড়িগঙ্গায় মিশছে। স্থানীয় লোকজন জানালেন, এমন অসংখ্য নালা আছে বুড়িগঙ্গার শ্যামপুরে। কিছু নালা মাটির নিচে স্থাপন করেছেন কারখানার মালিকেরা। ফলে সেগুলো খালি চোখে দেখা যায় না।

নদীর সাকার মাছও মরছে

মো. আনিসুল হক ১০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামপুরে মাছ ধরেন। আজ দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এই ব্যক্তি বুড়িগঙ্গা ইকোপার্ক অ্যান্ড শিপিং মিউজিয়ামের পেছনের তীরে জাল ফেলছিলেন। পাঁচবার জাল ফেলে পেয়েছেন অসংখ্য চগবগে (সাকার) মাছ ও দুটি টাকি মাছ। তিনি জানালেন, শ্যামপুর এলাকার ডাইং কারখানার নষ্ট পানি দিন–রাত নদীর পানিতে পড়ে। এতে পানি দুর্গন্ধ ও নোংরা হয়। ফলে নদীতে মাছ খুব কম পাওয়া যায়।

আনিসুল হক জাল বের করে দুটি সাকার মাছ দেখিয়ে বলেন, নদীতে অবশ্য এমনিতেও মাছ নেই। পানি এতই নোংরা যে সাকার মাছ মরে ভেসে উঠছে। তিন ঘণ্টা জাল ফেললে দু-একটা টাকি মাছ পাওয়া যায়। বেশি পাওয়া যায় সাকার মাছ। দুই বছর ধরে সাকার মাছ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

শ্যামপুরের বাসিন্দা মো. আনিসুল হক গত ১০ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় মাছ ধরেন। জানালের, ডাইং কারখানার বর্জ্যের কারণে নদীর পানি দূষিত। ফলে নদীতে মাছ খুব কম পাওয়া যায়
ছবি: আহমেদ দীপ্ত

নদীর পানি আগে কেমন ছিল জানতে কথা হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী ৫৯ বছর বয়সী মো. খায়রুদ্দিনের সঙ্গে। তাঁর বাসার নদীর ওপারে। এপারে শ্যামপুরে নিউ দোলেশ্বর আয়রন ওয়ার্কাসের মালিক তিনি। কারখানটি দুই মাস ধরে বন্ধ। খায়রুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা নদীর পানি আর আগের মতো নেই। ২০ বছর আগেও এই নদীতে গোছল করেছি। এখন হাত–পাও ধোয়া যায় না। খোসপাঁচড়া, চুলকানি হয়।’
লালবাগের বাসিন্দা ও বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার সদস্য মো. সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, নদীতীরে রাস্তার ওপারে ডাইং কারখানাগুলো। এর নোংরা পানি মাটির নিচ দিয়ে নদীতে এসে পড়ে। শ্যামপুরের ডাইংয়ের কারণে নদীর পানিদূষণ মারাত্মকভাবে হচ্ছে।

এটি বন্ধ করা খুব সহজ ব্যাপার। তবে প্রশাসন এটি বন্ধে তেমন একটি উদ্যোগ নেয় না। মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) আজীবন সদস্য হানিফ শহীদ, কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র প্রোগ্রাম এনালিস্ট সৈয়দ সুলতান চাঁদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।