শীতের আগেই আসছে পরিযায়ী পাখি
ডিসেম্বরে শীত তীব্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশে আসা শুরু করে। মার্চ পর্যন্ত দেশের জলাশয়গুলো পরিযায়ী পাখিদের কলকাকলিতে মুখর থাকে। এটাই ছিল এত দিনকার ধারণা। কিন্তু এবার পরিযায়ী পাখিদের অধিকাংশই মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিল। এরপর তারা ফিরে যায়। আর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে এরা বাংলাদেশে ফিরতে শুরু করেছে। অর্থাৎ বছরের অর্ধেক সময়জুড়ে এরা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ, প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব ও সুইডেনের লিনিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ওই সংস্থাগুলোর উদ্যোগে গত ফেব্রুয়ারিতে ৪৪টি পরিযায়ী পাখির শরীরে অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্র (জিপিএস ট্র্যাকার) বসানো হয়েছিল। এসব পাখির একটি ইতিমধ্যে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গোলিয়া থেকে পাবনার সুজানগরের পদ্মায় ফিরে এসেছে। আরেকটি পাখি হিমালয় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের কাছাকাছি ভারতের আসামের গুয়াহাটির কাছে ব্রহ্মপুত্র নদে অবস্থান করছে। আজকের মধ্যে এটি বাংলাদেশে চলে আসতে পারে বলে সংস্থাগুলোর গবেষকেরা ধারণা করছেন।
জিপিএস বসানো অন্য পাখিগুলোর মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আসার পথে ভারতের অরুণাচল-মিজোরামসহ বিভিন্ন রাজ্যে অবস্থান করছে। চলতি মাসের মধ্যে এরা বাংলাদেশে চলে আসবে বলে আশা করছেন গবেষকেরা। তবে এরা যে একা আসছে, তেমনটা নয়, সঙ্গে অন্য পরিযায়ী পাখিরাও আসছে। মূলত টাঙ্গুয়া ও হাকালুকি হাওর, বাইক্কার বিল, সোনাদিয়া ও নিঝুম দ্বীপে এসব পাখির বিচরণ বেশি থাকে।
>দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে
নানা ধরনের দূষণের কারণে পাখির সংখ্যা কমছে।
ওই গবেষণায় আরেকটি নতুন তথ্য উঠে এসেছে। সেটি হচ্ছে এত দিন বলা হতো, এসব পাখি রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আসে আর সেখানেই ফিরে যায়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, ওই ৪৪টি পাখির একটিও সাইবেরিয়ায় ফিরে যায়নি। মূলত চীন, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও তিব্বতের বিভিন্ন হ্রদে এসব পাখি এত দিন ছিল। ওই পাঁচ-ছয় মাস যে এরা একটি সুনির্দিষ্ট দেশে ছিল, তা নয়। একাধিক দেশে এরা ঘুরে বেরিয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশে আগেভাগে আসছে ও দেরিতে ফিরছে, এটা খুবই ভালো খবর। এদের সুরক্ষা দেওয়া ও যাতে এরা বাংলাদেশে নিরাপদে বেশি দিন অবস্থান করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। বন বিভাগের একার পক্ষে সেই কাজ করা সম্ভব নয়। পাখিগুলো যেসব এলাকায় অবস্থান করে, সেসব এলাকার স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জনগণেরও দায়িত্ব আছে। পাখিদের আবাসস্থলগুলো যাতে দূষিত না হয় এবং এদের যাতে মেরে ফেলা না হয়, সেটা নিশ্চিত করাটাও আমাদের দায়িত্ব।’
বার্ড ক্লাব ও আইইউসিএন থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখিদের শুমারি করা হয়। তাতে দেখা গেছে, গত ২০১৭-১৮ সালের তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে দেশে এক লাখ পরিযায়ী পাখি বেশি এসেছে। এর প্রায় ৯০ শতাংশ পাখিই গেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।
অবশ্য ২০০০ সাল থেকে হওয়া জলচর পাখিশুমারির তথ্য অনুযায়ী দেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। পাখির বিচরণ এলাকায় মানুষের বসতি ও তৎপরতা বেড়ে যাওয়া এবং নানা ধরনের দূষণের কারণে পাখির সংখ্যা কমছে।
গবেষকেরা জানান, ২০০০ সালে শুমারির সময় পাখি ছিল পাঁচ লাখের বেশি। ২০১৯ সালের শুমারিতে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ ৫টি এলাকায় পরিযায়ী পাখি দেখা গেছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৫টি, গত বছর যা ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ১৩০টি।
এ ব্যাপারে আইইউসিএনের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি কর্মকর্তা ও গবেষক এ বি এম সারোয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় পাখিদের বিচরণ এলাকা ও সময়কাল নিয়ে নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি। ফলে এসব পাখির সংরক্ষণের ব্যাপারে আমরা আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারব বলে আশা করছি। তবে প্রতিবছর যাতে আমাদের এখানে এসব পাখি আরও বেশি আসে, সে জন্য জলাভূমিগুলোর ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।’