শামুকখোলের রাজ্য
জলে বন্দী বন। জল আর বনের এমন প্রাকৃতিক মিত্রতাকে বলা হয় জলাবন। শীতে বনের আঁকাবাঁকা খালগুলোয় নৌকা চলাচলের উপযোগী পানি আছে। তারই দুই পাশে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল-করচগাছের ডালগুলোতে ঠাঁই নিয়েছে পাখি। কোনোটি গাছের কচিপাতায় ঠোকর দিচ্ছে, কোনোটি মেতেছে খুনসুটিতে। পর্যটকদের নৌকার শব্দ পেলেই ঝাঁক বেঁধে উড়াল দিচ্ছে হাজারো পাখি। এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে প্রকৃতিপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় থাকা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জলাবন রাতারগুলে।
পাখির নাম শামুকখোল। ২০১৩ সালের পর ২০২০ ও ’২১ সালে রাতারগুলে বেশি সংখ্যায় দেখা গিয়েছিল এ পাখি। মাঝের বছরগুলোতে একটু কম। করোনাকালের শুরু থেকে রাতারগুলে পর্যটকদের আসা নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। পর্যটক কম থাকায় বুনো পরিবেশ ফিরে পাওয়া বনে শামুকখোলের উপস্থিতি এবার আরও বেশি মনে করছেন স্থানীয় মানুষজন।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেল শামুকখোলের ঝাঁক। হিজল-করচের কচি পাতায় লম্বা ঠোঁটে ঠোকর দিচ্ছে। ডালের ওপর নড়াচড়া করছে নিরাপদে। খানিক পর বিশ্রাম নিচ্ছে দল বেঁধে। পর্যটকেরাও এমন দৃশ্য উপভোগ করছেন নৌকায় বসে। যেন পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে পাখিগুলো। সকাল-বিকেলে দেখা মেলে বেশিসংখ্যক শামুকখোলের।
স্থানীয় লোকজনের ভাষায়, ‘হামুকখাউড়ি’। শামুকখোল সিলেট অঞ্চলে ‘হামুকখাউড়ি’ নামেই পরিচিত। মিঠাপানির হাওর, বিল-ঝিলে শামুক ভেঙে ভেতরের অংশ খায় বলেই স্থানীয় লোকজনের কাছে এমন নাম! মাঝি নাজিম উদ্দিন জানান, রাতারগুল জলাবন নাম পরিচিতি পাওয়ার আগে বনের আশপাশের বাসিন্দারাই পাখি শিকার করতেন। পরিবেশকর্মীদের তৎপরতার ফলে বন ও প্রাণীর প্রতি দরদ বেড়েছে সবার। দিনমান হাওরে খাবার খেয়ে শামুকখোল এখন নিরাপদেই ফিরে আসে রাতারগুলে। শীতের রাতারগুল যেন পাখির রাজ্য।
১৯৭৩ সালে বন বিভাগ বনটিকে জলাবন হিসেবে সংরক্ষিত ঘোষণা করে। বনে হিজল-করচ-বরুণগাছের পাশাপাশি বেত, খাগড়া, মুর্তা, ইকরা ও শণজাতীয় গাছ রয়েছে। ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সঙ্গে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৭৫ প্রজাতির পাখি ও ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। নদী ও হাওরবেষ্টিত ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের বনটি অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। ২০১২ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রাতারগুলের একটি আলোকচিত্র প্রকাশিত হলে নতুন করে দেশব্যাপী পরিচিতি পায় রাতারগুল।
শামুকখোলের এমন বিচরণে রাতারগুল ‘প্রাণ’ ফিরে পাচ্ছে বলে মনে করেন পরিবেশকর্মীরা। সিলেটের পরিবেশ সংগঠন ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’-এর প্রধান সমন্বয়ক আশরাফুল কবির বলেন, রাতারগুলে শামুকখোল ফিরে এসেছে, এটা অবশ্যই সুখবর। ঘুরতে আসা পর্যটকদের পুরোপুরি সচেতন ও চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা গেলে বনে শামুকখোলের মতো সব প্রাণীর দেখা পাওয়া যাবে।
শামুকখোলের দুটি প্রজাতির একটি এশীয়, আরেকটি আফ্রিকান। এ দেশে এশীয় শামুকখোলের দেখা মেলে। বৈজ্ঞানিক নাম Anastomus oscitans। দুর্লভ আবাসিক এই পাখি বর্তমানে বন্য প্রাণী আইনে সংরক্ষিত পাখির তালিকায় রয়েছে। বন বিভাগের প্রাণী সংরক্ষণ দপ্তর থেকে ‘বিপদগ্রস্ত’ বলে ঘোষিত। এর গায়ের রং ধূসর সাদা। মাছ, কাঁকড়া, জলজ প্রাণী, ব্যাঙ পাখিটির প্রধান খাদ্য। লম্বা ও ভারী ঠোঁট দেখতে বকের মতো। শামুকখোল জলার পাখি। পানিতে বা পানির আশপাশে বসবাস করা পাখিদের জলজ বা জলার পাখিও বলা হয়।
সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. তৌফিকুল ইসলাম বললেন, বনের খালে পানি ও পর্যাপ্ত খাবার থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর শামুকখোলের উপস্থিতি আরও বেশি। শামুকখোলের এমন উপস্থিতি জানান দেয় রাতারগুলের জীববৈচিত্র্য স্বরূপে ফিরতে শুরু করেছে।