২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যেখানে বন্যা কম, সেখানেই আশ্রয়কেন্দ্র বেশি

বানের পানিতে ডুবে গেছে বাড়িঘর, পথঘাট। পরিবার আশ্রয় নিয়েছে উঁচু সড়কে। বাড়ির পানি সরে গেছে। কিন্তু এখনো কাদায় পরিপূর্ণ। মেয়ে জিমকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির অবস্থা দেখে ফিরছেন জামাল মিয়া। ডোবা পথে হেঁটে যাওয়ার জো নেই। গরুকে খাবার দেওয়ার পাত্রে বসে পারাপার হচ্ছেন তাঁরা।  গতকাল সকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার নয়াগ্রামে।  ছবি: আব্দুল আজিজ
বানের পানিতে ডুবে গেছে বাড়িঘর, পথঘাট। পরিবার আশ্রয় নিয়েছে উঁচু সড়কে। বাড়ির পানি সরে গেছে। কিন্তু এখনো কাদায় পরিপূর্ণ। মেয়ে জিমকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির অবস্থা দেখে ফিরছেন জামাল মিয়া। ডোবা পথে হেঁটে যাওয়ার জো নেই। গরুকে খাবার দেওয়ার পাত্রে বসে পারাপার হচ্ছেন তাঁরা। গতকাল সকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার নয়াগ্রামে। ছবি: আব্দুল আজিজ

দেশের তিন কোটি উপকূলবাসীর জন্য ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র আছে ৪ হাজার ২০০টি। আর বন্যাপ্রবণ এলাকার পাঁচ কোটি অধিবাসীর জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে মাত্র ১৫৩টি আশ্রয়কেন্দ্র। চালু হলে সেখানে বড় জোর এক লাখ মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।

দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারের ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ৪২টি জেলায় ৪২৩টি বহুমুখী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এর বেশির ভাগই অন্য সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হবে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের অংশ হিসেবে ১৫৩টি এখন নির্মাণাধীন। আর এসব কেন্দ্রের বেশির ভাগই নির্মিত হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম বন্যাপ্রবণ এলাকায়। আর বেশি বন্যাপ্রবণ এলাকায় কম আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।

সবচেয়ে বেশি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে চাঁদপুরে, ৩২টি। আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ওই প্রকল্প অনুমোদনের সময় ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ও সচিব শাহ কামাল। দুজনেরই জেলা হিসেবে চাঁদপুর বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। অথচ দেশের সবচেয়ে বন্যাপ্রবণ জেলা রংপুরে মোটে ৪টি, রাজবাড়ীতে ৫টি, নঁওগায় ৬টি, গাইবান্ধায় ৮টি, লালমনিরহাটে ৯টি, কুড়িগ্রামে ১২টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব জেলায় প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়। সরকারের দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী সবচেয়ে দরিদ্র জেলা হচ্ছে কুড়িগ্রাম।

অন্যদিকে কম বন্যা হয়, এমন জেলা কিশোরগঞ্জে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৬টি, কুমিল্লায় ২৫টি, সুনামগঞ্জে ২৫টি, সিলেটে ২৩টি ও নেত্রকোনায় ২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। ওই জেলাগুলোতে বন্যার প্রবণতা উত্তরাঞ্চলের চেয়ে অনেক কম। দেশের দারিদ্র্য মানচিত্রের দিক থেকে এসব জেলা কম দারিদ্র্যপ্রবণ। এসব জেলায় বেশি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পেছনে বন্যার ঝুঁকি ও দারিদ্র্যের চেয়ে রাজনৈতিক চাপকে বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

>সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগমন্ত্রী ও সচিবের জেলা চাঁদপুরে সবচেয়ে বেশি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র হচ্ছে। উত্তরের বন্যাপ্রবণ জেলাগুলোতে এ সংখ্যা অনেক কম।

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, দেশে এর আগেও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের এলাকা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই ধারা অনুসরণ করা হলো। এটা কাম্য নয়। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে, আর বন্যার ঝুঁকি ও দেশের দারিদ্র্য মানচিত্র বিবেচনায় না নিয়ে এগুলো নির্মাণ করা ঠিক হয়নি। এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি অর্থের অপচয় হয়, একই সঙ্গে দেশের দরিদ্র ও দুর্যোগপ্রবণ মানুষের ক্ষতি হয়। কারণ, তাদের কল্যাণের জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে। তারাও এর সুবিধা থেকে থেকে বঞ্চিত হয়। পরবর্তী যেকোনো প্রকল্পে রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে বিশেষজ্ঞ মতামত ও গবেষণার তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে নির্মাণ করা উচিত বলে তিনি মত দেন।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রকল্পটি চালু অবস্থায় পেয়েছি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে যে বৈষম্যের বিষয়টি শুনলাম, তা পরবর্তী প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা বিবেচনায় নেব।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, এরই মধ্যে বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ৫৫০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণের যে কাজ শুরু হয়েছে, তাতে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও যমুনা অববাহিকার বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য এবারের বন্যায় দেশের দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোর মানুষকে বেশি ভোগাবে। এরই মধ্যে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জে প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। ১৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব মানুষের বড় অংশ এখন পর্যন্ত কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি। এসব দুর্গত মানুষ বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে; অনেকে ঘরের টিনের চালে অবস্থান করছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমি আর ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেই। আর এত আগের কথা মনেও নেই।’

সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী দু-তিন দিনের মধ্যে বন্যার আরেকটি ঢল উজান থেকে আসতে পারে। এতে কমপক্ষে আরও ১০টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে। ফলে আরও কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দী হতে চলেছে। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় প্রতিবছর এসব বন্যার্ত মানুষ সড়কে, বাঁধে ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। এতে তাদের জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

জাতিসংঘসহ উন্নয়ন সহযোগীদের ২০১৯ সালের বন্যা ও আশ্রয়কেন্দ্র শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর মাঝারি বন্যাতেই দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ৭৬ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। ১১৯ জন মারা যায় ও তিন লাখ মানুষ বাঁধ ও অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করে।