বনবিড়াল

বনবিড়াল গাছে চড়েছে l ছবি: সঞ্জীব দেব
বনবিড়াল গাছে চড়েছে l ছবি: সঞ্জীব দেব

তিন দিনে তেরোটি মুরগির ছানা শিকার করার পরে বনবিড়ালটিকে (Jungle Cat) গুলি করে মারার দায়িত্ব পড়ল চৌদ্দ বছরের এক বালকের ওপর। এ পাড়ায় বন্দুক একটিই আছে, সেটি এই ছেলেটির বাবার। বাবা সরকারি চাকুরে, কর্মস্থল সুন্দরবনঘেরা শরণখোলা। বাবা এখন বাড়িতে থাকলে ছেলেটিকে আর বন্দুক হাতে নিতে হতো না।
বনবিড়ালটি বলতে গেলে ডাকাতের মতো দিনে- দুপুরে উঠোনে লাফিয়ে পড়ে তিনটি মুরগিমাতাকে প্রায় সন্তানহারা করে ফেলেছে। মুরব্বিরা বলছেন, বাচ্চা হয়েছে ওটির, তাই এমন মরিয়া হয়ে উঠেছে। আস্তানা ওর বুড়ির বাগানে।
ঝড়ে কাত হয়ে পড়া একটি কাউফলগাছ বেয়ে ওপরে উঠে নারকেলগাছটার ডগার ওপরে বসল ছেলেটি, নিচ থেকে লোড করা বন্দুক তুলে দিলেন এক চাচা, তিনিই একটা ঝোপের পাশে খাঁচাবন্দী তিনটি মুরগির ছানা রেখে সরে গেলেন দূরে। ছানাগুলো ‘চিউ চিউ’ স্বরে ডাকছে। এই চিউ চিউই হলো ফাঁদ। বনবিড়ালের কানে এই শব্দ গেলে ছুটে আসবে ও।
প্রায় ২৫ মিনিট বাদে পা টিপে টিপে বাঁশঝাড়ের গোড়া থেকে যেটিকে নেমে আসতে দেখল ছেলেটি, তাতে তার পিলে চমকে গেল। চিতাবাঘের বাচ্চা! সর্বনাশ! বাচ্চা যখন আছে, তখন ওটার মা-ও আছে আশপাশে! প্রচণ্ড ভয়ে ছেলেটি চিৎকার শুরু করল, ভয়ে খাঁচার পাশ থেকে ছিটকে সরে গেল চিতাবাঘের বাচ্চাটি। দৌড়ে এল অনেকেই। ঘটনা শুনে প্রবীণেরা বললেন, চিতাবাঘের বাচ্চা নয়, ওটা হলো ‘বাঘের চিতামাসি’। ওটা এক ধরনের বনবিড়াল।
সেই ছেলেটি পরে আরও কয়েকবার এখানে-সেখানে দেখেছিল চিতামাসিকে—দুএক পলকের জন্য। সেই বালক এখন বৃদ্ধজন। সে তাঁর এলাকার (বৃহত্তর খুলনা জেলা, সুন্দরবন বাদে) সর্বশেষ এক জোড়া চিতাবিড়াল দেখেছিল ১৯৯৪ সালে, নিজ গ্রামের এক বাগানে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর দেখা পায়নি অনেক খুঁজেও। সুন্দরবনে আছে।
চিতাবাঘের যেন ক্ষুদ্র সংস্করণ এই বাঘের চিতামাসির ইংরেজি নাম Leopard Cat. বৈজ্ঞানিক নাম felis bengalensis. লেজ বাদে শরীরের মাপ ৬৩ সেন্টিমিটার। লেজ ২৯ সেন্টিমিটার। ওজন আড়াই কেজি থেকে সাড়ে চার কেজি। এক নজরে হলুদাভ- বাফ রঙা শরীরে এদের চিতাবাঘের মতো বাদামি বা কালো বুটি বুটি দাগ, লেজ-পায়েও একই রকম বুটি। কানের পেছনে সাদা গোলাকার ছোপ আছে—বাঘের মতোই। গাছে চড়তে ওস্তাদ, কুশলী শিকারি, তুখোড় সাঁতারু ও দারুণ দৌড়বিদ এই বনবিড়ালটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট বনবিড়াল। গাছে চড়ে রাতে এরা ছোট ছোট পাখি ও পাখির ছানা শিকার করে, বাসার ডিম চুরি করে। এক লাফে সাত ফুট দূরত্ব এরা অনায়াসে পার হতে পারে। খাদ্যতালিকায় আছে পোকা-পতঙ্গ-ব্যাঙ-মাছ-ইঁদুর-হাঁস-মুরগির ছানা ইত্যাদি।
নিশাচর এই প্রাণীটি সাধারণত লতাপাতায় ছাওয়া বড় গাছের কাণ্ড বা কোটরে দিনভর ঘুমায়-ঝিমায়। বাচ্চাও তোলে কোটরে। প্রতিবারে ২-৪টি ছানা প্রসব করে। বন্দী বা পোষা অবস্থায়ও বাচ্চা দেয়। গর্ভধারণকাল ৬৫-৭০ দিন। প্রয়োজনে ঘাড় কামড়ে ধরে ছানাদের এরা স্থানান্তর করতে পারে।
এরা আছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম-সিলেটের পাহাড়-টিলাময় বনে, উত্তরের গারো পাহাড় শ্রেণিতে। সুন্দরবন লাগোয়া গ্রামীণ বনেও আজকাল দেখা পাওয়া ভার।
লেখার শুরুতে যে বালকের কথা বলেছি, আমিই সেই বালক।