টিকে থাক দেশি মেটে হাঁস
সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের হাতিরগাতা বিলের কান্দাটি শুষ্ক মৌসুমে মাস চারেক পানির ওপর জেগে থাকে। এক যুগ ধরে প্রতিবছরই পাখি গবেষণার কাজে এখানে তাঁবু করে থেকেছি। দিনে কিছু মানুষের আনাগোনা থাকলেও রাতের এলাকাটি একদম সুনসান। মাঝেমধ্যে হাঁস পাখির শব্দ।
হাঁসের সর্বশেষ অবস্থা দেখতে এ বছরের ১৭ মার্চ টাঙ্গুয়ার হাওরে যাত্রা করেও মাঝপথে ফিরে আসতে হয়েছে। করোনাকালে আটকে যাওয়ার ভয়। তবে স্থানীয় মাঝি আর বন্ধুদের মাধ্যমে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা গেছে। সে কথায় ঢোকার আগে একটা গল্প বলা যাক।
২০১২ সালের এপ্রিলের এক সকালে বেলাল নামের একজন মাঝি খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর কাছে উদ্ধার করা দেশি মেটে হাঁসের বাচ্চা আছে। হাতিরগাতা থেকে বারকি নৌকায় চটাইন্ন্যার বিলে পৌঁছাতে সময় লাগল আধঘণ্টা। কী যে সুন্দর ৯টি বুনো হাঁসের বাচ্চা! হাওরের বুনো পরিবেশে এমন হাঁসের বাচ্চা দেখেছি। হাতে ধরে কখনো দেখিনি। বাচ্চাগুলোকে বের করতে না করতে আকাশে ছোটাছুটি শুরু হলো ওগুলোর মা-বাবার। ওরা ঠুকরে দিতে এল। ওদের এত আক্রমণাত্মক হতে আগে দেখিনি। বাচ্চাগুলো ছেড়ে দিলে মা-বাবা ফিরে গেল শান্ত হয়ে।
এটি একটি দেশি মেটে হাঁস পরিবারের পুনর্মিলনের গল্প। টাঙ্গুয়ার হাওরে শীতের শেষ থেকে বর্ষার আগ পর্যন্ত দেখা যায় এদের ধরার দৃশ্য। হাওর থেকে এই বুনো হাঁসটি তাই ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালও বলছে, ভারত উপমহাদেশের এই পাখি দিন দিন কমে যাচ্ছে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে দেশি মেটে হাঁসের প্রধান শত্রু মানুষ ও গরুর পাল। শীতে শত শত গরু হাওরের কান্দাগুলো দখল করে রাখে। আর গরু চরানো মানুষেরা বুনো হাঁসগুলোর ডিম খুঁজে বেড়ায়। ছয় কুড়ি কান্দা আর নয় কুড়ি বিল নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর। হাঁসের বাসা বানানোর জন্য এখন হয়তো এক কুড়ি কান্দাও টিকে নেই।
এবার বুনো হাঁসের কথা বলি। বাংলাদেশে মাত্র দুই জাতের বুনো হাঁস ডিম পেড়ে বাচ্চা ফোটায়। ধলা বালিহাঁস ও দেশি মেটে হাঁস। বাকি অন্য ২৪ জাতের হাঁসের মধ্যে সবগুলোই পরিযায়ী। দেখা মেলে শীতে। শুমারিতে প্রতিবছর এ মৌসুমে দুই লাখের মতো পরিযায়ী হাঁস পাখির খবর মেলে। অথচ দেশি মেটে হাঁস মাত্র কয়েক শ।
২০০৮ সাল থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে দেশি মেটে হাঁসের শুমারি হয়। এই ১৩ বছরে গড়ে ৪৮৪টি করে হাঁস দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৭১২টি আর সবচেয়ে কম ২০১৬ সালে মাত্র ১৩টি। এ বছরের জানুয়ারির শুমারিতে মাত্র ৯১টি হাঁস দেখা গেছে। টাঙ্গুয়ার বাইরে হাকালুকি হাওরেও হাঁসটির দেখা মেলে। তবে সংখ্যায় গড়ে মাত্র ৪০টি।
একসময় বাংলাদেশের সব জলাশয়ে দেশি মেটে হাঁস দেখা যেত। গত দুই যুগের পরিসংখ্যান বলছে, হাওর ছাড়া পদ্মার কিছু বড় বড় চরেও এদের দেখা যায়। পদ্মার গোদাগাড়ী অংশের পশ্চিমের চরগুলোতে ২০০৮ সালে এক শুমারিতে এদের বাসা দেখার তথ্য আছে। এরপর ওই অংশে মানুষের চাপ বেড়েছে। হাঁসগুলো জায়গা বদল করেছে। নিরাপদ আবাসের খোঁজে কোথায় গেছে কে জানে!
সংসারের জন্য দেশি মেটে হাঁসের প্রথম পছন্দ নলবন বা ঘাসবন। হাওর এলাকায় এসব বেশি। নিরাপদ কিছু বন টিকে আছে টাঙ্গুয়ার হাওরে। নলবনের প্রাচুর্যই এখানে অপেক্ষাকৃত বেশি হাঁসের রহস্য। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রতিবছর এ হাঁসের সংখ্যা কমলেও বেড়েছে দেশি গরুর সংখ্যা। সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, গরুর সংখ্যা বেড়েছে ২০ গুণের বেশি। হাঁসের প্রাকৃতিক আবাস হয়ে উঠেছে গোচারণভূমি। সংখ্যা কমার এটিই কারণ।
এখন হাওর ফাঁকা। করোনায় অন্য কাজে প্রশাসন ব্যস্ত হয়ে পড়ায় জেলেরা মাছ ধরছেন দেদার। তবে দৌরাত্ম্য কমেছে গরুওয়ালাদের। গরুর মহাজনেরা আগেভাগে বিল থেকে গরু উঠিয়ে নেওয়ায় দেশি মেটে হাঁসের প্রজননে কিছুটা সুবিধা হয়েছে। আগামী বছর শুমারিতে ভালো ফলের জন্য হাত গুটিয়ে রইলাম।