ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: সবচেয়ে বেশি ক্ষতি ফসল ও মাছের
সুন্দরবনে বাধা পেয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ দুর্বল হয়ে আঘাত হানে উপকূলে। দেশের ১৬টি উপকূলীয় জেলায় এই ঝড় কমবেশি আঁচড় কেটেছে। নিজের ক্ষতি সয়ে সুন্দরবন দেশের উপকূলবাসীকে আরও বেশি ক্ষতি হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। শনিবার রাতের এই ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মাঠের ফসল ও মাছের।
বন বিভাগ সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শুরু করেছে, এখনো তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে সুন্দরবনের ভেঙে পড়া গাছ যাতে চুরি না হয়, সে জন্য আগামী পাঁচ দিনের জন্য বনে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সরকারি হিসাবে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে মারা গেছে নয়জন। আটজনই মারা গেছে গাছ চাপা পড়ে। তবে ঝড়ের কবলে পড়ে ভোলার মেঘনা ও ইলিশা নদীর মোহনায় গত রোববার একটি ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে।
২৪ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলারটি চাঁদপুর থেকে ছেড়ে এসেছিল। এ সময় ১০ জনকে পুলিশ ও কোস্টগার্ড উদ্ধার করে। ১৪ জন নিখোঁজ ছিল। ওই দিন রাতে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আবদুল্লাহপুর মেঘনা থেকে খোরশেদ আলম নামের একজনকে এবং গতকাল সন্ধ্যায় আরও আট জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ নিয়ে এই ঝড়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৭।
বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ লাখ ৭০ হাজার উপকূলবাসী। আর আন্তর্জাতিক সংস্থা রিলিফ ওয়ার্ল্ডের হিসাবে এই সংখ্যা ২০ লাখ। তবে ক্ষয়ক্ষতির এখনো চূড়ান্ত হিসাব শেষ হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আক্রান্ত ১৬ জেলায় ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চাওয়া হয়েছে। হিসাব চূড়ান্ত করতে আরও সপ্তাহখানেক লাগবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রাথমিক হিসাব তৈরি করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি জেলায় ৩০ লাখ করে টাকা ও ১ হাজার বান্ডিল টিন এবং মাঝারি ক্ষতিগ্রস্ত চারটি জেলায় ১৫ লাখ করে টাকা এবং ৫০০ বান্ডিল টিন বরাদ্দ দিয়েছি।’ ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পর প্রায় ২১ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি কমেছে বলে মনে করেন তিনি।
>মোট আক্রান্ত মানুষ সরকারি হিসাবে ১০ লাখ ৭০ হাজার। বেসরকারি হিসাবে ২০ লাখ। ক্ষতিগ্রস্ত জেলা ১৪টি। ১৭ জনের মৃত্যু।
তবে ঝড়ে ফসলের বেশি ক্ষতি হয়েছে। এই সময়ে মাঠে ছিল আধা-পাকা আমন ধান আর শীতকালীন সবজি। ঝড়ের পূর্বাভাস থাকার পরও তা কাটা সম্ভব হয়নি। আর ঝড়ের সঙ্গে আসা তুমুল বৃষ্টি ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। বিশেষ করে শীতকালীন সবজি, সরিষা, পানের বরজের ক্ষতি উদ্বেগজনক। আজ মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব এবং কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় দেওয়া সাহায্য বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হবে।
আমন, সবজি ও মাছের ক্ষতি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর জমির ফসল ঝড়ের কবলে পড়েছে। ফসল নষ্ট হয়েছে ২ থেকে ৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ভোলা, বরগুনা, খুলনা ও পটুয়াখালী জেলায়। এসব জেলার মাঠগুলোতে মূলত শীতকালীন সবজি ছিল। মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শাকসহ অন্যান্য সবজির বেশির ভাগই প্রায় বিক্রয়যোগ্য অবস্থায় ছিল। পর্যায়ক্রমে তা মাঠ থেকে তোলা হচ্ছিল। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের নতুন করে ওই সব সবজি চাষ করার সুযোগ নেই এবং তাঁদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বেশি হবে।
অন্যদিকে দেশের ১০টি উপকূলীয় জেলার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায়। জলোচ্ছ্বাস ও অতিবৃষ্টির কারণে সেখানকার মাছের ঘের থেকে প্রচুর মাছ নদীতে ভেসে গেছে। আর্থিক মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৭ কোটি টাকা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী শামস আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাছের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের সহযোগিতারও উদ্যোগ নিয়েছি। সরকারের কাছে ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে আমরা এ ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা জমা দেব।’
মৃতের সংখ্যা কত
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে মোট নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আটজনই গাছ চাপা পড়ে মারা গেছে। আরেকজন ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ১৪টি জেলা ঘূর্ণিঝড়–আক্রান্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাবে ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে এবং অন্যান্য কারণে ১৩ জন মারা গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে যে ১৪টি জেলাকে ঘূর্ণিঝড়–আক্রান্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তার বাইরেও দুটি জেলা রয়েছে। শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলায়ও ঝড়ের কারণে ফসল ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। মারাও গেছে ওই দুই জেলায় একজন করে। কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তালিকায় ওই জেলা আক্রান্ত জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি।
সুন্দরবনের ক্ষতির হিসাব হচ্ছে
বুলবুল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশের আগে প্রাথমিক বাধা পেয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশ সুন্দরবনে। দুই দেশের সরকারই নিজ নিজ অংশে বনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করার কাজ শুরু করেছে। প্রাথমিক হিসাবে বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ বঙ্গোপসাগরের কাছে সুন্দরবনের গাছপালার ক্ষয়ক্ষতির খবর নিশ্চিত করেছে। কিন্তু কোনো প্রাণীর মৃত্যু বা মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ার কোনো তথ্য তারা পায়নি। বন বিভাগের হিসাবে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার অন্তর্ভুক্ত সুন্দরবনের অংশের ক্ষতি বেশি হয়েছে। বিশেষ করে খুলনার নলীয়ান, সাতক্ষীরা গাবুরা, বাগেরহাটের মোংলা এবং শরণখোলা এলাকার পার্শ্ববর্তী বনের ক্ষতি বেশি হয়েছে বলে ধারণা করছে বন বিভাগ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বন বিভাগের প্রধান সংরক্ষক মোহাম্মদ সফিউল আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শুরু করেছি। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে আমাদের বন ফাঁড়িগুলোরও কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করব।’